Skip to main content

সূরা আলে-ইমরানের (৩৫-৩৭) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: মারইয়াম (আ.) এর জন্মের কাহিনী।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿إِذْ قَالَتِ امْرَأَتُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (35) فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنْثَى وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنْثَى وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وَإِنِّي أُعِيذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ (36) فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنْبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنًا وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِنْدَهَا رِزْقًا قَالَ يَا مَرْيَمُ أَنَّى لَكِ هَذَا قَالَتْ هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ (37)﴾ [سورة آل عمران: 35-37].

 

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: মারইয়াম (আ.) এর জন্মের কাহিনী।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৩৫। যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল: হে আমার রব! নিশ্চয় আমি আমার গর্ভে যা আছে একান্তভাবে আপনার জন্য মানত করলাম; অতএব আপনি তা আমার পক্ষ থেকে কবুল করুন, নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা মাহজ্ঞানী।
৩৬। অতঃপর যখন সে তা প্রসব করলো, তখন সে বললো: হে রব! নিশ্চয় আমি তা প্রসব করেছি একটি কন্যা, বস্তুত আল্লাহই ভালো জানেন যা সে প্রসব করেছে; আর পুত্র সন্তান কন্যা সন্তানের মতো নয়, এবং নিশ্চয় আমি তার নাম রেখেছি মারইয়াম; আর নিশ্চয় আমি তার এবং তার বংশধরের ব্যাপারে আপনার কাছে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় চাচ্ছি ।
৩৭। অতঃপর তার রব উত্তমভাবে তা কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমভাবে গড়লেন; এবং তার দায়িত্ব দিলেন যাকারিয়্যাকে; যখনই যাকারিয়্যা মেহরাবে তার কাছে প্রবেশ করতো, তখনই তার কাছে রিযিক উপস্থিত দেখতে পাইতো; সে বলতো: হে মারইয়াম! এগুলো কোথা থেকে আসে তোমার জন্য? সে বলতো: তা আল্লাহর পক্ষ থেকে; নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দেন ।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
যারা ঈসা (আ.) কে ইলাহ এবং আল্লাহর ছেলে বলে বিশ্বাস করে তাদের যৌক্তিক জবাব দেওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা প্রদান পূর্বক আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহকে (সা.) সম্বোধন করে বলেছেন: তিনি যেন ইমরানের স্ত্রী হান্না বিনতে ফাক‚দের মানতের কথা স্মরণ করেন। যখন তিনি গর্ভে সন্তান ধারণ করলেন, তখন মানত করেছিলেন তার গর্ভের সন্তানকে বায়তুল মাক্বদাসের খেদমতের উদ্দেশ্যে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করবেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর কাছে তার মনের একান্ত ইচ্ছাকে কবূল করার জন্য এ বলে দোয়া করেছিলেন: “হে আল্লাহ! আমার মানতকে কবূল করুন, নিশ্চয় আপনি আমার মানতকে শুনেছেন এবং আমার মনের বাসনা সম্পর্কে জেনেছেন”।
অতঃপর হান্না বিনতু ফাক‚দ যখন দেখলেন তিনি মেয়ে সন্তান প্রসব করেছেন, তখন তিনি তার মানতের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে বলেছিলেন: হে আমার রব! আমি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছি, সে তো বায়তুল মাকদাসে খেদমত করার উপযুক্ত নয়। বস্তুত: তিনি যা প্রসব করেছেন তার হাক্বীকত সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। তিনি একজন পুত্র সন্তানের আশা করেছিলেন; কারণ তার ধারনা ছিল বায়তুল মাকদাসে খেদমতের জন্য যে পরিমাণ শক্তি-সামর্থ দরকার, তা একজন মেয়ের পক্ষে সম্পাদন করা সম্ভব হবে না। অবশেষে তিনি নবজাতকের নাম মারইয়াম রেখে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন: “আল্লাহ যেন তাকে এবং তার বংশধরকে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় দান করেন”।
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া ও মানতকে যথার্থভাবে কবুল করে মারইয়ামের লালন-পালনের দায়িত্বভার যাকারিয়্যা (আ.) এর উপর অর্পণ করেছিলেন। ফলে, তার তত্বাবধানে মাসজিদুল আক্বসার ভিতরে আল্লাহ প্রদত্ত জান্নাতী রিযিক আহরণ করে সে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে থাকে। যাকারিয়্যাহ (আ.) যখনই মসজিদের মিহরাবে তার কাছে প্রবেশ করতেন, তখনই তার কাছে অমৌসুমী পবিত্র সুস্বাদু ফলমূল সহ বিভিন্ন ধরণের খাবার দেখতে পেতেন। আর তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করতেন এ সুস্বাদু খাবার কোথা থেকে আসে? তখন সে উত্তর দিতো, এ খাবার আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন। (তাফসীর আল-মারাগী: ১৪৪-১৪৫, আইসার আল-তাফসীর: ১/৩১১, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৪, আল-মোন্তাখাব: ১/৯০) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿امْرَأَتُ عِمْرَانَ﴾ “ইমরানের স্ত্রী”, আয়াতাংশে ‘ইমরান’ দ্বারা ইমরান ইবনু মাসানকে বুঝানো হয়েছে, যিনি মারইয়াম (আ.) এর পিতা এবং ঈসা (আ.) এর নানা। তিনি নবী ছিলেন না, বরং তিনি একজন সৎ ব্যক্তি ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম হলো: হান্না বিনতু ফাক‚দ, যিনি যাকারিয়্যা (আ.) এর স্ত্রীর বোন ছিলেন। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩১০) ।
﴿نَذَرْتُ﴾ “আমি মানত করেছি”, আরবী ভাষার শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ হলো: আমি নিজের জন্য আবশ্যক করে নিয়েছি। ‘মানত’ এর শরয়ী অর্থ হলো: “শরীয়াতে ওয়াজিব নয় এমন কোন বিষয়কে নিজের উপর ওয়াজিব করে নেওয়া”।
মানত করার জন্য যে শব্দ ব্যবহার হয়: ‘নাযারতু লিল্লাহি কাযা’ অর্থাৎ: আমি আল্লাহর জন্য অনুরুপ করার মানত করলাম, ‘নাযারতু কাযা ওয়া কাযা’ অর্থাৎ: আমি অনুরুপ অনুরুপ করার মানত করলাম, ইত্যাদি।
মানতের হুকুম: মানত পূর্ণ করা ওয়াজিব।
মানতের শর্ত: মানতের বিষয়টি এমন না হওয়া যা পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর অবাধ্যতা হয়, এমন বিষয় হওয়া যা মানতকারীর স্বক্ষমতার ভিতরে থাকে, এমন বস্তুর মানত করা যার মালিক মানতকারী, মানত এমন জায়গার সাথে সম্পর্কিত না হওয়া যেখানে গায়রুল্লাহর ইবাদত হয় এবং মানত পালন করাকে কোন বিষয়ের সাথে লটকিয়ে না দেওয়া। (আলুকা পেইজ থেকে)।
﴿قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنْثَى وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنْثَى﴾ তাফসীরকারকগণ আয়াতাংশের দুইটি অর্থ করেছেন:
(ক) তিনি বললেন: হে আমার রব! আমি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছি, সে তো বায়তুল মাকদাসে খেদমত করার উপযুক্ত নয়; কারণ একটি কন্যা সন্তান শক্তি-সামর্থের দিক থেকে একটি ছেলে সন্তানের সমান হতে পারে না। বস্তুত: তিনি যা প্রসব করেছেন তার হাক্বীকত সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। (আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৪) ।
(খ) তিনি বললেন: হে আমার রব! আমি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছি। বস্তুত: তিনি যা প্রসব করেছেন তার হাক্বীকত সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। সে যে উদ্দেশ্যে পুত্র সন্তান চেয়েছিল তা বাস্তবায়নে পুত্র সন্তানের চেয়ে এই কন্যা সন্তানটিই বেশী উপকারে আসবে। (আল-মোন্তাখাব: ১/৯০) ।
﴿مُحَرَّرًا﴾ “স্বাধীনভাবে”, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: একনিষ্ঠভাবে বা ইখলাসের সাথে, যেখানে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা হয় না। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৩৫) ।
﴿وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا﴾ “এবং যাকারিয়্যাকে তার তত্বাবধানের দায়িত্ব দিলেন”, আয়াতাংশে ‘যাকারিয়্যাহ’ (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন নবী। তিনি ‘সোলাইমান’ (আ.) এর বংশধর। ‘ইয়াহইয়া’ (আ.) এর পিতা এবং ‘মারইয়াম’ (আ.) এর খালু। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২০২; তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২১০) ।
﴿الْمِحْرَابَ﴾ “আল-মিহরাব”, মিহরাব হলো মসজিদের সামনের অংশে অবস্থিত উচু জায়গা, যা সাধারণ ইবাদতকারীদের জায়গা থেকে একটু আলাদা এবং তাদের আড়ালে থাকে। যাকারিয়া (আ.) মেহরাবে সিড়ি দিয়ে উঠতেন। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৪২) ।
﴿رِزْقًا﴾ “রিযিক”, আয়াতের বর্ণনাভঙ্গি থেকে বুঝা যায় ‘রিযিক’ দ্বারা অমৌসুমী পবিত্র সুস্বাদু বিস্ময়কর ফলমূলকে বুঝানো হয়েছে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২০৭) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। পয়ত্রিশ নাম্বার আয়াতে নিম্নের কয়েকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ইমরানের স্ত্রী হান্না বিনতু ফাক‚দ বন্ধা ছিলেন, বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তার কোন সন্তান হয়নি। অবশেষে বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের প্রতি প্রবল বাসনা জন্মালে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। অতঃপর তাঁর হুকুমে তিনি অন্তঃসত্ত¡ায় উপণিত হন।
(খ) হান্না বিনতু ফাক‚দ (র.) তার গর্ভাস্থ সন্তানকে আল্লাহর পথে মানত করেছিলেন। সুতরাং কোন মায়ের জন্য তার গর্ভাস্থ সন্তানকে আল্লাহর পথে মানত করা জায়েজ।
(গ) দোয়ার সময় আল্লাহর সুন্দর সুন্দর গুণবাচক নাম ব্যবহার করা উত্তম। হান্না বিনতু ফাক‚দ (র.) তার দোয়ায় আল্লাহর দুইটি গুণবাচক নাম ‘সামী’ এবং ‘আলীম’ এর অসীলা করেছিলেন। একই নির্দেশ আল্লাহ তায়ালা সূরা আরাফ এর ১৮০ নাম্বার আয়াতে দিয়েছেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২১২-২১৩) ।
২। ছত্রিশ নাম্বার আয়াতে কয়েকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে হান্না বিনতু ফাক‚দ নবজাতকের নাম রেখেছিলেন ‘মারইয়াম’, পরবর্তীতে যার ঔরশে পিতা বিহীন ঈসা (আ.) এর জন্ম হয়েছিল।
(খ) নবজাতক কেমন হবে তার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তায়ালার কাছে রয়েছে, যা দুনিয়ার কোন মানুষ জানে না; কারণ আল্লাহ তায়ালা আয়াতে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন নবজাতকের হাক্বীকত সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন।
(গ) নারীদের সম্মানিত করা হয়েছে, সকল নারী মানের দিক থেকে পুরুষের নীচে নয়, বরং কিছু নারী রয়েছে যারা অনেক পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
(ঘ) নবজাতক এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সুরক্ষার জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা উত্তম; কারণ হান্না বিনতু ফাক‚দ নবজাতকের জন্য দোয়া করেছিলেন।
৩। সাইত্রিশ নাম্বার আয়াতে তিনটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) আল্লাহ তায়ালা হান্না বিনতু ফাক‚দ (র.) এর দোয়া উত্তমরুপে কবূল করেছিলেন।
(খ) মারইয়ামের (আ.) তত্বাবধানের দায়িত্ব যাকারিয়্যা (আ.) এর উপর অর্পিত হয়েছিল।
(গ) মারইয়ামকে (আ.) আল্লাহ তায়ালা বিশেষ জাতের খাবার বিযিক হিসেবে প্রদান করেছিলেন। এ থেকে বুঝা যায় আল্লাহর ওয়ালীদের কারামাত সত্য।
৪। উল্লেখিত আয়াতবলীতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর রিসালাতের সত্যতার প্রমাণ রয়েছে; কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) ‘উম্মী’ ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে না জানালে এ ঘটনা জানা তার পক্ষে কখনও সম্ভব হত না। এ জন্যই ঘটনা বর্ণনার উপসংহারে ৪৪ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: “এটা অদৃশ্য সংবাদ, যা আপনাকে প্রত্যাদেশ করেছি”। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩১২) ।
৫। উল্লেখিত আয়াতাবলীতে মানতের ব্যাপারে আলোচনা এসেছে, এ সম্পৃক্ত মাসয়ালা নি¤েœ:
‘মানত’ এর শরয়ী অর্থ: “শরীয়াতে ওয়াজিব নয় এমন কোন বিষয়কে নিজের উপর ওয়াজিব করে নেওয়া”।
মানত করার জন্য যে শব্দ ব্যবহার হয়: ‘নাযারতু লিল্লাহি কাযা’ অর্থাৎ: আমি আল্লাহর জন্য অনুরুপ করার মানত করলাম, ‘নাযারতু কাযা ওয়া কাযা’ অর্থাৎ: আমি অনুরুপ অনুরুপ করার মানত করলাম, ইত্যাদি।
মানতের হুকুম: মানত পূর্ণ করা ওয়াজিব।
মানতের শর্ত:
(ক) মানতের বিষয়টি এমন না হওয়া যা পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর অবাধ্যতা হয়।
(খ) এমন বিষয় হওয়া যা মানতকারীর স্বক্ষমতার ভিতরে থাকে।
(গ) এমন বস্তুর মানত করা যার মালিক মানতকারী।
(ঘ) মানত এমন জায়গার সাথে সম্পর্কিত না হওয়া যেখানে গায়রুল্লাহর ইবাদত হয়।
(ঘ) মানত পালন করাকে কোন বিষয় অর্জনের সাথে শর্তযুক্ত না করা। (আলুকা পেইজ থেকে)।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) ভালো কাজের মানত করা।
(খ) গুরুত্বপূর্ণ কাজ সফল করতে আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
(গ) নবজাতক যেন শয়তানের পথ পরিহার করে আল্লাহর পথে বেরে উঠে সে জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা।
(ঘ) আল্লাহর ওয়ালীদের কারামাত সত্য, এ কথা বিশ্বাস করা।

সূরা আলে-ইমরানের (৩৩-৩৪) আয়াতের তাফসীর, আয়াতদ্বয়ের আলোচ্যবিষয়: যুগে যুগে নবী নির্বাচন।

By Uncategorized, দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوحًا وَآلَ إِبْرَاهِيمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ (33) ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (34)﴾ [سورة آل عمران: 33-34].

 

আয়াতদ্বয়ের আলোচ্যবিষয়: যুগে যুগে নবী নির্বাচন।

আয়াতদ্বয়ের সরল অনুবাদ:
৩৩। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আদম, নূহ, ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে সৃষ্টি জগতের উপর বাছাই করেছেন ।
৩৪। তারা একে অপরের বংশধর, আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা মহাজ্ঞানী।

আয়াতদ্বয়ের ভাবার্থ:
মানুষ কর্তৃক আল্লাহকে ভালোবাসা এবং আল্লাহ কর্তৃক মানুষকে ভালোবাসার পদ্ধতি বর্ণনার পর আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে ভালোবেসে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তাদের তালিকা উল্লেখ পূর্বক তিনি বলেন: নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা মোহাম্মদ (সা.) কে যেমন রাসূল হিসেবে নির্বাচন করে তার অনুসরণকে তাঁকে ভালোবাসার মাধ্যম বানিয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে আদম, নূহ, ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে সৃষ্টিজগতের উপর নবী-রাসূল হিসেবে বাছাই করেছিলেন।
আদম (আ.) হলেন মানবজাতির আদি পিতা, আল্লাহ তায়ালার বাছাইকৃত একজন নবী।
নূহ (আ.) হলেন মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা, তার সময়ে মহা তুফান সংগঠিত হয়েছিল। তিনি এবং ঈমানদারগণ নৌকায় আরোহণ করে মৃত্যু থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তার বংশ থেকে অনেক নবী-রাসূল প্রেরিত হয়েছিলেন।
ইব্রাহীম (আ.) একজন নবী এবং রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। তার বংশ থেকে সর্বাধিক সংখ্যক নবী-রাসূল প্রেরিত হয়েছেন; এজন্য তাকে নবীদের পিতা বলা হয়। তার বংশ থেকে আগত উল্লেখযোগ্য নবী-রসূলগণ হলেন: ইসমাঈল (আ.), ইসহাক্ব (আ.), ইয়কুব (আ.) এবং ইউসূফ (আ.)। ইমরান (আ.) আল্লাহর একজন অনুগত বান্দা ছিলেন। তার ঔরশে এসেছে ঈসা (আ.) এবং তার মা মারইয়াম (আ.)।
উল্লেখিত সকলে একে অপরের বংশধর, যেমন: ইসহাক, ইসমাঈল, ইয়ক‚ব (আ.) এরা সবাই ইব্রাহীম (আ.) এর বংশোদ্ভুত, ইব্রাহীম (আ.) হলেন নূহ (আ.) এর বংশোদ্ভুত এবং নূহ (আ.) এসেছেন আদম (আ.) থেকে। আর আল্লাহ তায়ালা তাঁর সকল বান্দার কথা শুনেন, তাদের সকল কাজ সম্পর্কে জানেন এবং সে অনুযায়ী কিয়ামতের দিন পুরস্কার দিবেন। (তাফসীর আল-মারাগী: ১৪২-১৪৩, আইসার আল-তাফসীর: ১/৩১০, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৪, আল-মোন্তাখাব: ১/৯০) ।

আয়াতদ্বয়ের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿اصْطَفَى آدَمَ وَنُوحًا﴾ “তিনি আদম ও নূহ (আ.) কে বাছাই করেছেন”, আয়াতাংশে ‘আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বাছাই করেছেন’ এর অর্থ কি? ইমাম যাজাজ (র.) এর দুইটি অর্থ করেছেন:
(ক) আল্লাহ তায়ালা তাদের দ্বীনকে অন্য সকল দ্বীনের উপর বাছাই করেছেন।
(খ) আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ‘রিসালাত’ এর জন্য বাছাই করেছেন। (মায়াানি আল-কোরআন, আবু ইসহাক্ব আল-যাজাজ: ১/৩৯৯) ।
﴿وَآلَ إِبْرَاهِيمَ﴾ “এবং ইব্রাহীমের বংশধর”, ইমাম তাবারী (র.) বলেন: আয়াতাংশে ‘আাল’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: বংশধর, অনুসারী এবং যারা তার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইব্রাহীম (আ.) এর বংশধর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়কুব, ইউসূফ (আ.) এবং মোহাম্মদ (সা.) সহ যারা তার বংশে এসেছে। (তাফসীর আল-তাবারী: ৬/৩২৬, আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২০১)।
﴿وَآلَ عِمْرَانَ﴾ “এবং ইমরানের বংশধর”, আয়াতাংশে ‘ইমরান’ দ্বারা কাকে বুঝানো হয়েছে? এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের থেকে দুইটি মত পাওয়া যায়:
(ক) ইমরান ইবনু ইয়াসহার এর বংশধর মূসা ও হারুন (আ.) কে বুঝানো হয়েছে।
(খ) ইমরান ইবনু মাসান এর বংশধর ঈসা (আ.) এবং তার মা মারইয়াম (আ.) কে বুঝানো হয়েছে। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো এক হাজার আট শত বছর। (তাফসীর আল-নাসাফী: ১/২৪৯) । তবে আয়াতে উভয় ইমরানকে উদ্দেশ্য করা হলে অর্থের মধ্যে কোন ধরণের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে না। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।
﴿ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ﴾ “তারা একে অপরের বংশধর”, এর দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ ব্যাপারে তাফসীরকারকদের থেকে দুইটি মত পাওয়া যায়:
(ক) তাওহীদ, ইখলাস এবং অনুগত হওয়ার ভিত্তিতে তারা সবাই একে অপরের বংশধর।
(খ) তারা সবাই আদম (আ.) এর ঔরসজাত সন্তান হিসেবে একে অপরের বংশধর। তাহলে আয়াতে উদ্দেশ্য হলো: আদম (আ.) ছাড়া বাকী সকলে একই বংশধর। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২০১)।
উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ে সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে মানুষ কর্তৃক আল্লাহকে ভালোবাসা এবং আল্লাহ কর্তৃক মানুষকে ভালোবাসার পদ্ধতি বর্ণনার পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলুল্লাহর (সা.) অনুসরণ একটি অপরটির পরিপূরক বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ে আলোচনা করা হয়েছে যে আল্লাহ তায়ালা পূর্ববর্তী যুগে যাদেরকে ভালোবেসে নবী-রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন তারাও মানুষের কাছে আল্লাহকে ভালোবাসার একই পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২১১) ।

আয়াতদ্বয়ের শিক্ষা:
১। উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ে দুই শ্রেণীর মানুষের ভ্রান্ত দাবীর জবাব রয়েছে:
(ক) মুশরিক, যারা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে নবী হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি জানায়; কারণ তারা মনে করে একজন মানুষ নবী হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জবাবে বলেন: তোমরা সকলে আদম (আ.) কে নবী হিসেবে বিশ্বাস করে থাকো, অথচ তিনি শুধু একজন মানুষই ছিলেন না, বরং তিনি মানবজাতির আদি পিতা ছিলেন।
(খ) বনী ইসরাঈল, যারা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে নবী হিসেবে মানে না; কারণ তারা মনে করে নবী হবে একমাত্র বনী ইসরাঈল থেকে অন্য কোন গোত্র থেকে নবী হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার জবাবে বলেন: তিনি আদম ও নূহ (আ.) কে নবী হিসেবে বাছাই করেছেন। অতঃপর তাদের বংশধর থেকে ইব্রাহীম (আ.) কে নবী হিসেবে বাছাই করেছেন। অতঃপর তার বংশধর থেকে আগত ইমরানের বংশধরকেও নবী হিসেবে বাছাই করেছেন। আর আল্লাহ আরব থেকে মোহাম্মাদ (সা.) কে রাসূল হিসেবে বাছাই করেছেন, যিনি ছিলেন ইসমাঈলের বংশধর, আর ইসমাঈল (আ.) হলেন ইব্রাহীম (আ.) এর সন্তান। সুতরাং বনী ইসরাঈলরা যে মোহাম্মদ (সা.) কে ইব্রাহীম (আ.) এর বংশ থেকে আলাদা করতে চায়, তা অযৌক্তিক এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ২১৪-২১৫) ।
২। উল্লেখিত আয়াতদ্বয় থেকে দুইটি বিষয় খুবই স্পষ্টভাবে বুঝা যায়:
(ক) পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলের ধারাবহিকতায় মোহাম্মদ (সা.) ও একজন রাসূল। তারা সবাই যেমন মাটির তৈরি মানুষ রাসূলুল্লাহও (সা.) তাদের মতোই মাটির তৈরি মানুষ। এর মাধ্যমে তার মর্যাদা কমে যায় না। যেমনটা অনেকেই মনে করে থাকেন।
(খ) সকল নবী-রাসূল সম্পর্কের দিক থেকে ভাইয়ের মতো, তারা বিভিন্ন গোত্রের হলেও সকলের ধর্ম এক। এ সম্পর্কে একটি হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-: “أَنَا أَوْلَى النَّاسِ بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، وَالْأَنْبِيَاءُ إِخْوَةٌ لِعَلَّاتٍ، أُمَّهَاتُهُمْ شَتَّى وَدِينُهُمْ وَاحِدٌ” (صحيح البخاري: ৩৪৪৩).
অর্থাৎ: আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “আমি দুনিয়া-আখেরাতে ঈসা ইবনু মারইয়ামের ঘনিষ্ঠতম। নবীগণ একে অপরের বৈমাত্রেয় ভাই। তাদের মা ভিন্ন, কিন্তু দ্বীন হলো এক”। (সহীহ আল-বুখারী: ৩৪৪৩) ।

আয়াতদ্বয়ের আমল:
আদম (আ.) থেকে শুরু করে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল একই গঠন, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যে আগমণ করেছেন এ কথার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা।

সূরা আলে-ইমরানের (৩১-৩২) আয়াতদ্বয়ের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: আল্লাহর ভালোবাসা পেতে রাসূলুল্লাহর (সা.) অনুসরণ শর্ত।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ (31) قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ (32)﴾ [سورة آل عمران: 31-32].

আয়াতদ্বয়ের আলোচ্যবিষয়: আল্লাহর ভালোবাসা পেতে রাসূলুল্লাহর (সা.) অনুসরণ শর্ত।

আয়াতদ্বয়ের সরল অনুবাদ ও শব্দার্থ:
৩১। বলো: যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো; আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং ক্ষমা করে দিবেন তোমাদের অপরাধসমূহ; বস্তুতঃ আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।
৩২। বলো: তোমরা অনুসরণ করো আল্লাহর এবং রাসূলের, কিন্তু যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে ভালোবাসেন না।

আয়াতদ্বয়ের ভাবার্থ:
নাজরান থেকে আগত খৃষ্টান প্রতিনিধি দল ঈসা (আ.) এবং তার মা মারইয়াম (আ.) কে সম্মান প্রদর্শন ও অনুসরণ করাকে আল্লাহর ভালোবাসা লাভের একমাত্র উপায় দাবী করলে আল্লাহ তায়ালা তাদের ভ্রান্ত দাবীকে খন্ডন পূর্বক রাসূলুল্লাহ (সা.) কে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি যেন তাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন তারা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চায়, তাহলে যেন ঈসা ও মারইয়ামের (আ.) অনুসরণ বাদ দিয়ে মোহাম্মদ (সা.) এর অনুসরণ করে। তারা যদি তাকে অনুসরণ করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তাদের যাবতীয় পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন।
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মাধ্যমে নাজরানের খৃষ্টান সহ সকল মানুষকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তারা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) কে অনুসরণ করতে অস্বীকার করে, তাহলে তারা আল্লাহর ক্রোধে পতিত হবে এবং তিনি তাদেরকে কখনও ভালোবাসবেন না। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩০৮, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৪, আল-মোন্তাখাব: ১/৮৯) ।

আয়াতদ্বয়ের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿تُحِبُّونَ اللَّهَ﴾ “তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো”, সকল তাফসীরকারক একমত যে, আল্লাহকে ভালোবাসার অর্থ হলো: তাঁর বড়ত্ব, মহত্ব এবং অনুসরণকে ভালোবাসা। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/১৯৭) ।
﴿يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ﴾ “আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন”, সকল তাফসীরকারক একমত যে, আল্লাহকর্তৃক মানুষকে ভালোবাসার অর্থ হলো: “মানুষের জন্য কল্যাণ, ক্ষমা এবং রহমতকে ভালোবাসা”। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/১৯৭) ।
﴿لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ﴾ “আল্লাহ কাফেরদেরকে ভালোবাসেন না”, সকল তাফসীরকারক একমত যে, আয়াতাংশের অর্থ হলো: “আল্লাহ কাফেরদের প্রতি কল্যাণ, ক্ষমা এবং রহমতকে ভালোবাসেন না”। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৬০) ।
উল্লেখিত আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতবলীতে আল্লাহর কামালিয়াত, তাঁর ক্ষমতা এবং তাকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা অর্জনের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং আয়াতাবলীর মধ্যে সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা আল-জুহাইলী: ৩/১৯৯) ।

৩১ নাম্বার আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
হাসান ও ইবনু জুরাইজ (র.) বলেন: কতিপয় কাফির-মুশরিক রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বললো: হে মোহাম্মদ! আল্লাহর কসম করে বলছি: আমরা অবশ্যই আমাদের রবকে ভালোবাসি। অতঃপর অত্র আয়াত অবতীর্ণ করে আল্লাহকে ভালোবাসার পদ্ধতি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন। (লুবাব আল-নুক‚ল, সুয়ূতী: ৬২) ।
মোহাম্মদ ইবনু জা’ফর (র.) বলেন: অত্র আয়াত নাজরানের খৃষ্টান সম্পর্কে অবতীর্ণ করা হয়েছে। বিস্তারিত ঘটনা হলো: তারা রাসূলুল্লাহর কাছে এসে বললো: আমরা আল্লাহকে ভালোবেসেই এবং তাঁকে সম্মান করেই ঈসা (আ.) কে সম্মান দেই এবং তার ইবাদত করি। অতঃপর অত্র আয়াত অবতীর্ণ করে আল্লাহকে ভালোবাসার পদ্ধতি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন। (আসবাব আল-নুযূল, ওয়াহেদী: ১/১০৬) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। একত্রিশ নাম্বার আয়াতটি যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসার দাবী করে তার প্রতি বিচারক হিসেবে কাজ করে। সে যদি তার সকল কাজে ও কথায় রাসূলুল্লাহকে (সা.) অনুসরণ করে থাকে, তাহলে সে তার দাবীতে সত্যবাদী। অন্যথায় সে তার দাবীতে মিথ্যাবাদী। এজন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “কোন ব্যক্তি যদি এমন কাজ করে, যার আমি নির্দেশ করিনি তা অগ্রাহ্য” (সহীহ মুসলিম: ১৭১৮)।
হাসান বসরী (র.) বলেছেন: “কেউ যদি মনে করে সে আল্লাহকে ভালোবাসে, তাহলে আল্লাহ এ আয়াতের মাধ্যমে তাকে পরীক্ষা করে থাকেন”। (তাফসীর ইবনু কাসীর: ২/৩২) ।

২। সকল তাফসীরকারক একমত যে, বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহকে ভালোবাসার অর্থ হলো: তাঁর আনুগত্য হওয়াকে ভালোবাসা। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাকে ভালোবাসার অর্থ হলো: বান্দার পাপসমূহ ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসা। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/১৯৭) ।

৩। ‘আল-মাহাব্বাহ’ বা ‘ভালোবাসা’ এর সমার্থবোধক আরবী ভাষায় আরেকটি শব্দ পাওয়া যায় ‘আল-ইশক্ব’। আমাদের সমাজে এ শব্দটিকে আল্লাহর শানে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহ তায়ালার শানে কি এ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে?
এর উত্তরে ইবনুল কাইয়্যূম (র.) বলেন: সুফী সম্প্রদায় এ শব্দটিকে আল্লাহর শানে ব্যবহার করে থাকলেও জমহুর ওলামার মত হলো: আল্লাহর শানে ‘আল-ইশক্ব’ শব্দটি আল্লাহর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না। তারা কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন:
(ক) কোরআন-সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কিরামের জীবন চারিতায় ‘আল-মাহাব্বাহ’ ছাড়া অন্য কোন শব্দ আল্লাহর শানে ব্যবহার হয়েছে মর্মে কোন নস পাওয়া যায় না।
(খ) ‘আল-ইশ্ক্ব’ শব্দের মধ্যে ভালোবাসার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির অর্থ নিহীত রয়েছে, যা আল্লাহর শানে বেমানান। এছাড়ও ‘ইশ্ক্ব’ শব্দটি শাহওয়াত মিশ্রিত ভালোবাসার জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। আরবী ভাষাবিধদের কাছে ‘আল-ইশ্ক্ব’ শব্দটি যাকে বিবাহ করা যায় কেবল তার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। (তালবীসু ইবলীস, ইবনুল জাওযী: ১৫৩) । আবু হেলাল আসকারী (র.) বলেন: ‘আল-ইশ্ক্ব’ শব্দটি কেবল মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে। (আল-ফুরুক্ব, আল-আসকারী: ১/১২২) ।
(গ) ‘আল-হুব্ব’ বা ‘ভালোবাসা’ আল্লাহর একটি গুণ, এটাকে অন্য কোন শব্দ দিয়ে পরিবর্তন করা যাবে না। (তালবীসু ইবলীস, ইবনুল জাওযী: ১৫৩) ।

৪। আমাদের সমাজে আরেকটি বিষয় খুব বেশী পরিলক্ষিত হয় যে, আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূলকে (সা.) নিয়ে এমন ভালোবাসা ও বিরহের গান গাওয়া হয়, যেমনটা প্রেমিক তার প্রেমিকাকে হারিয়ে এবং প্রেমিকা তার প্রেমিককে হারিয়ে গেয়ে থাকে। এটা অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) শানে বেআদবী। এর মাধ্যমে এ ধরণের গানের লেখক ও গায়ক কাফের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার অর্থ হলো: তাঁর বড়ত্ব, মহত্ব এবং অনুসরণকে ভালোবাসা আর রাসূলুল্লাহকে (সা.) ভালোবাসার অর্থ হলো আল্লাহর প্রেরিত রাসূল হিসেবে তাকে অনুসরণ করা। তাদের প্রতি নিজের ভালোবাসাকে যদি প্রকাশ করতেই হয়, তাহলে তা হবে তাদের প্রতি সম্মান রেখে শরয়ী পদ্ধতিতে। এজন্য লেখক ও গায়কদের উচিৎ গান-কবিতা লেখার পর শরয়ী বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তা কারেকশন করে নেওয়া। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

৫। ইমাম ওয়াহাবা জুহাঈলী (র.) বলেন: আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সা.) প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায় তাদেরকে অনুসরণের মাধ্যমে, মুখে বলার মাধ্যমে নয়। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২০৮) ।

৬। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে ভালোবাসেন নাকি ঘৃণা করেন, তা কিভাবে বুঝবেন?
এর অতি সহজ উত্তর হলো: যদি দেখেন সাধারণ মানুষ, আপনার অধিনস্ত কর্মচারী, সহপাঠী, সহকর্মী, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ এবং পরিবারের সদস্যের অধিকাংশই আপনাকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধাভরে ভালোবাসেন, আপনার অনুপস্থিতে আপনার জন্য দোয়া করেন, আপনার অজান্তে অন্যের সাথে আপনার প্রশংসা করেন এবং আপনি সমস্যায় পতিত হলে তারা কষ্ট পায়, তাহলে বুঝবেন আল্লাহ আপনাকে ভালোবাসেন। কিন্তু যদি এর বিপরীত দেখেন, তাহলে মনে করবেন আল্লাহ তায়ালা আপনাকে ঘৃণা করেন। যেমন: এ সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“إِنَّ اللهَ إِذَا أَحَبَّ عَبْدًا دَعَا جِبْرِيلَ فَقَالَ: إِنِّي أُحِبُّ فُلَانًا فَأَحِبَّهُ، قَالَ: فَيُحِبُّهُ جِبْرِيلُ، ثُمَّ يُنَادِي فِي السَّمَاءِ فَيَقُولُ: إِنَّ اللهَ يُحِبُّ فُلَانًا فَأَحِبُّوهُ، فَيُحِبُّهُ أَهْلُ السَّمَاءِ، قَالَ ثُمَّ يُوضَعُ لَهُ الْقَبُولُ فِي الْأَرْضِ، وَإِذَا أَبْغَضَ عَبْدًا دَعَا جِبْرِيلَ فَيَقُولُ: إِنِّي أُبْغِضُ فُلَانًا فَأَبْغِضْهُ، قَالَ فَيُبْغِضُهُ جِبْرِيلُ، ثُمَّ يُنَادِي فِي أَهْلِ السَّمَاءِ إِنَّ اللهَ يُبْغِضُ فُلَانًا فَأَبْغِضُوهُ، قَالَ: فَيُبْغِضُونَهُ، ثُمَّ تُوضَعُ لَهُ الْبَغْضَاءُ فِي الْأَرْضِ” (صحيح مسلم: ২৬৩৭).
অর্থাৎ: “নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন জিবরীল (আ.) কে ডেকে বলেন: আমি অমুককে ভালোবাসি, অতএব তুমিও তাকে ভালোবাসতে থাকো। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: অতঃপর জিবরীল (আ.) তাকে ভালোবাসতে শুরু করেন। অতঃপর তিনি আকাশবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন: অমুককে আল্লাহ ভালোবাসেন, অতএব তোমরাও তাকে ভালোবাসতে থাকো। অতঃপর আকাশবাসী তাকে ভালোবাসতে শুরু করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: ফলে যমীনবাসীর কাছেও তাকে ভালোবাসার পাত্র হিসেবে পেশ করা হয়। অপরদিকে আল্লাহ তায়ালা যখন কোন বান্দাকে ঘৃণা করেন, তখন জিবরীল (আ.) কে ডেকে বলেন: আমি অমুককে ঘৃণা করি, অতএব তুমিও তাকে ঘৃণা করতে থাকো। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: অতঃপর জিবরীল (আ.) তাকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। অতঃপর তিনি আকাশবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন: অমুককে আল্লাহ ঘৃণা করেন, অতএব তোমরাও তাকে ঘৃণা করতে থাকো। অতঃপর আকাশবাসী তাকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন: ফলে যমীনবাসীর কাছেও তাকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে পেশ করা হয়” (সহীহ মুসলিম: ২৬৩৭।

৭। আল্লাহ তায়ালাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসা বন্দার উপর ওয়াজিব। যেমন: কোরআনের একটি আয়াতে এসেছে:
﴿وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ﴾ [سورة البقرة: ১৬৫].
অর্থাৎ: “যারা ঈমানদার, তারা আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে” (সূরা বাক্বারা: ১৬৫) ।
আল্লাহর পরে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসবে রাসূলুল্লাহকে (সা.), অতঃপর পিতা-মাতা, অতঃপর সন্তানসস্তুতি, অতঃপর পর্যায়ক্রমে বাকীদেরকে ভালোবাসবে। যেমন: আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ” (صحيح مسلم: ১৭৮).
অর্থাৎ: “যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তোমাদের কাছে তোমাদের পিতামাতা, সন্তানসন্তুতি এবং সকল মানুষের চেয়ে বেশী প্রিয় হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কেউ পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না” (সহীহ মুসলিম: ১৭৮) ।

৮। বত্রিশ নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অনুসরণকে কেউ অস্বীকার করলে সে কাফের হয়ে জাহান্নামী হয়ে যায়। তাকে অনুসরণের গুরুত্বের ব্যাপারে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে। এ ব্যাপারে একটি বিখ্যাত হাদীস হলো:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-، قَالَ: “كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ إِلَّا مَنْ أَبَى”، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَمَنْ يَأْبَى؟ قَالَ: “مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى” (صحيح البخاري: ৭২৮০).
অর্থাৎ: আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যারা অস্বীকার করে, তারা ছাড়া আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন: কারা জান্নাতে প্রবেশ করতে অস্বীকার করবে। তিনি উত্তরে বললেন: যারা আমাকে অনুসরণ করে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং যারা আমার অবাধ্য হয়, তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে অস্বীকার করে। (সহীহ আল-বুখারী: ৭২৮) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের জন্য রাসূলুল্লাহকে (সা.) অনুসরণ করা।
(গ) মুখের কথা দিয়ে নয়, বরং আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রতি আনুগত্য পোষণের মাধ্যমে তাদেরকে ভালোবাসা।

সূরা আলে-ইমরানের (২৮-৩০) আয়াতের তাফসীর, আয়াতের আলোচ্যবিষয়: কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿لَا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ (28) قُلْ إِنْ تُخْفُوا مَا فِي صُدُورِكُمْ أَوْ تُبْدُوهُ يَعْلَمْهُ اللَّهُ وَيَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (29) يَوْمَ تَجِدُ كُلُّ نَفْسٍ مَا عَمِلَتْ مِنْ خَيْرٍ مُحْضَرًا وَمَا عَمِلَتْ مِنْ سُوءٍ تَوَدُّ لَوْ أَنَّ بَيْنَهَا وَبَيْنَهُ أَمَدًا بَعِيدًا وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ (30)﴾ [سورة آل عمران: 28-30].

 

আয়াতের আলোচ্যবিষয়: কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা।

আয়াতের সরল অনুবাদ:
২৮। মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফিরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করে; আর যে কেউ এরুপ করবে, আল্লাহর সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না; তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন ভয়ের আশংকা করো, তা হলে ভিন্ন কথা; আর আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে তাঁর শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন; এবং আল্লাহর দিকেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন।
২৯। হে নবী! আপনি বলুন: যদি তোমরা গোপন রাখো অথবা তোমরা প্রকাশ করো যা তোমাদের অন্তরে রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তা জানেন; তিনি আরো জানেন আকাশসমূহে এবং যমীনে যা কিছু আছে; এবং আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
৩০। যেদিন প্রত্যেকে সে যা ভালো কাজ এবং মন্দ কাজ করেছে, তার উপস্থিতি পাবে; সেদিন সে কামনা করবে, যদি তার মধ্যে এবং দুষ্কর্মের মধ্যে বহুদুর ব্যবধান হতো; আর সতর্ক করেছেন তোমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর শাস্তির ব্যাপারে; এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দার প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ।

আয়াতের ভাবার্থ:
আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারকে তার মুমিন ভাইকে বাদ দিয়ে কাফিরদেরকে অভিভাবক বা অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন; কারণ পূর্বের আয়াতবলীতে মুমিন কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে এমন ক্ষমতাধর আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থণা করতে বলা হয়েছে, যিনি সকল ক্ষমতার উৎস, তিনি সেচ্ছায় কাউকে ক্ষমতার আসনে বসিয়ে সম্মানিত করেন আবার কাউকে ক্ষমতাচ্যুতের মাধ্যমে লাঞ্চিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন। এমন উত্তম আশ্রয়দাতাকে বাদ দিয়ে তাঁর দুশমনকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা স্বভাবতই বোকামী।
যারা এ নিষেধকে উপেক্ষা করে কাফেরদেরকে বন্ধু বা অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবে তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার চারটি সতর্কবার্তা রয়েছে:
(ক) তাদের সাথে আল্লাহ তায়ালার কোন সম্পর্ক থাকবে না।
(খ) তাদেরকে যথার্থ শাস্তি দিতে আল্লাহ তায়ালা সক্ষম। মূলতঃ সবাই তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান লাভের জন্য আস্তে আস্তে তাঁরই দিকে ফিরে যাচ্ছে।
(গ) কাফেরদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার কোন বাসনা কারো অন্তরে থাকলে তা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা জানেন। তিনি শুধু মানুষের অন্তরের খবর রাখেন না, বরং আকাশ-যমীনে যা কিছু আছে সবকিছু সম্পর্কে তিনি জানেন। আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
(ঘ) কাফেরদেরকে বন্ধু বানানো গর্হিত কাজ, আর প্রত্যেকেই তাদের ভালো-মন্দ কৃতকার্যের জন্য আখেরাতে প্রতিদান পাবে। সেদিন একদলকে মন্দ কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে বিলাপ করতে দেখা যাবে।
আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে বিশেষ ওজরের ক্ষেত্রে কাফেরদের সাথে বন্ধুভাব আচরণ জায়েয রেখেছেন। যেমন: কাফেরদের থেকে কোন ধরণের ভয় বা ক্ষতির আশংকা থাকলে তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করা যাবে। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩০৬, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৩-৫৪, আল-মোন্তাখাব: ১/৮৯) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿أَوْلِيَاءَ﴾ “বন্ধুগণ”, শব্দটি বহুবচন, এক বচনে ‘ওয়ালি’। ইমাম আবু বকর আল-জাযায়িরী (র.) বলেন: আয়াতাংশের অর্থ হলো: কাউকে ভালোবাসা, সহযোগিতা এবং সমর্থন প্রদানপূর্বক বন্ধু বানানো।
﴿وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ﴾ “আল্লাহ তোমাদেরকে তার নিজের ব্যাপারে সতর্ক করছেন”, এর অর্থ হলো: “তোমরা আল্লাহর অবাধ্য হলে তিনি তোমাদেরকে তাঁর শাস্তি ব্যাপারে সতর্ক করছেন”। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩০৫)।

উল্লেখিত আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতবলীতে মুমিন কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে এমন ক্ষমতাধর আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থণা করতে বলা হয়েছে, যিনি সকল ক্ষমতার উৎস, তিনি সেচ্ছায় কাউকে ক্ষমতার আসনে বসিয়ে সম্মানিত করেন আবার কাউকে ক্ষমতাচ্যুতের মাধ্যমে লাঞ্চিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন। আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে আল্লাহ তায়ালার মতো এমন উত্তম আশ্রয়দাতাকে বাদ দিয়ে তাঁর দুশমন কাফির সম্প্রদায়কে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা আল-জুহাইলী: ৩/১৯৯) ।

(২৮-২৯) আয়াতদ্বয় অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: হাজ্জাজ ইবনু আমর নামক সাহাবী কা’ব বিন আশরাফ, ইবনু উবাই আল-হাক্বীক্ব এবং ক্বাইস ইবনু যায়েদ নামক ইহুদীদের সহযোগী ছিল। তার মাধ্যমে ইহুদী গ্রুপটির সাথে একদল আনসারী সাহাবীর সখ্যতা গড়ে উঠে, যা তাদের ঈমানের জন্য বড় পরীক্ষা ছিল। অতঃপর রিফায়াহ ইবনুল মুনজির, আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর এবং সাঈদ ইবনু খাইসামাহ তাদেরকে ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করলে তারা সম্পর্ক ছিন্ন করতে অস্বীকার করে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সতর্ক করানোর জন্য (২৮-২৯) আয়াত অবতীর্ণ করেন। (লুবাব আল-নুক‚ল, সুয়ূতী: ৬২) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। ইবনু বায (র.) সহ অধিকাংশ ওলামায়ে কিরাম বলেছেন, (২৮-২৯) নাম্বার আয়াতে কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: তাদেরকে অন্তর দিয়ে ভালোবেসে, সহযোগিতা করে এবং তাদের আক্বীদা-বিশ্বাসকে সমর্থন দিয়ে বন্ধু বানানো। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩০৫)। উল্লেখিত অর্থে কাফিরদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বা অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা কবীরা গুনাহ; কারণ নিষেধাজ্ঞার পরেও যারা কাফেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে, তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক চারটি সতর্কবার্তা প্রদান করা হয়েছে:
(ক) তাদের সাথে আল্লাহ তায়ালার কোন সম্পর্ক থাকবে না।
(খ) তাদেরকে যথার্থ শাস্তি দিতে আল্লাহ তায়ালা সক্ষম।
(গ) কাফেরদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার কোন বাসনা কারো অন্তরে থাকলে তা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা জানেন।
(ঘ) কাফেরদেরকে বন্ধু বানানো গর্হিত কাজ, আর প্রত্যেকেই তাদের ভালো-মন্দ কৃতকর্মের জন্য আখেরাতে প্রতিদান পাবে।
২। তবে আঠাশ নাম্বার আয়াতের শেষাংশ থেকে বুঝা যায়, কাফেরদের থেকে যদি কোন ভয়-ভীতি এবং ক্ষয়ক্ষতির আশংকা থাকে, তাহলে পবিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করা জায়েজ।
৩। আঠাশ নাম্বার আয়াতের শেষাংশ থেকে বুঝা যায় ইসলামে ‘তাকিয়া’ বা “আত্মরক্ষার জন্য অন্তরে সত্যকে লুকিয়ে রেখে মুখে ভিন্ন কিছু প্রকাশ করা” বৈধ। তবে এর ধরণ কেমন হবে তা নিয়ে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত’ এবং ‘রাফিযী’ সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মতে, “বড় ধরণের ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে অন্তরে যা বিশ্বাস করে তার বিপরীত কিছু উচ্চারণ বা প্রকাশ করাকে ‘তাকিয়া’ বলে”। তারা মনে করেন ‘তাকিয়া’ এর আসল হলো হারাম, তবে নি¤œবর্ণিত কয়েকটি শর্তের আলোকে তা বৈধ:
(ক) ‘তাকিয়া’ করার প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান থাকা, যেমন: ‘তাকিয়া’ এর আশ্রয় না নিলে কতল, প্রচন্ড শাস্তি, যে কোন অঙ্গ কর্তন ইত্যাদি বড় ধরণের ক্ষতির আশংকা করা। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৫৭) ।
(খ) আশংকা করা ক্ষতির পরিমাণ এমন হওয়া যে তা সহ্য করা কঠিন হবে।
(গ) ‘তাকিয়া’ ছাড়া অন্য কোন উপায় না থাকা। অন্য কোন উপায় থাকলে, তা অবলম্বন করা।
(ঘ) ‘তাকিয়া’ কেবল কাফেরের সাথে করা যাবে।
অপর দিকে শীয়া সম্প্রদায়ের একটি গ্রুপ ‘রাফিযী ইসনা আশারিয়্যাহ’, যারা ‘তাকিয়া’ কে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের বিরুদ্ধে সর্বক্ষণিক ব্যবহার করাকে ওয়াজিব মনে করে থাকে। তাদের কাছে ‘তাকিয়া’ দ্বীনের মৌলিক বিষয়ের একটি, সালাত কায়েম করা যেমন ফরজ, তেমনিভাবে ‘তাকিয়া’ অবলম্বন করাও ফরজ। তারা বিশ্বাস করে যারা ‘তাকিয়া’ অবলম্বন করে না, তারা দ্বীন থেকে খারিজ হয়ে যায়। তারা তাদের পঞ্চম ইমাম জাফর সাদিকের দিকে সম্বন্ধ করে একটি কথা বলে থাকে, তিনি বলেছেন: “তাকিয়া আমার এবং আমার পিতৃপুরুষের ধর্ম, যারা এটাকে অস্বীকার করে, তারা দ্বীনকে অস্বীকার করে”। (মাযহাব শীয়া ইমামিয়্যাহ: ২/৮০৬-৮০৭)।
উল্লেখিত দুইটি মতের মধ্যে বিশেষ কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়:
(ক) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত ‘তাকিয়া’ কে প্রয়োজনের সময় প্রয়োজন পরিমাণ জায়েজ মনে করেন, প্রয়োজন কেটে গেলে তা আর জায়েজ থাকে না। অপরদিকে ‘রাফিযী’ সম্প্রদায় এটাকে দ্বীনের মৌলিক বিষয় ধরে সর্বক্ষণিক আমল করাকে ওয়াজিব মনে করেন।
(খ) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত ‘তাকিয়া’র উপর আমলকে ‘রুখসাত’ এবং এর উপর আমল না করাকে ‘আযীমাত’ মনে করেন। আর এ ক্ষেত্রে আযীমাত এর উপর আমল করা উত্তম। অপরদিকে ‘রাফিযী’ সম্প্রদায় এটাকে দ্বীনের রুকন মনে করে থাকেন, যার অস্বীকারকারী দ্বীন থেকে খারিজ হয়ে যায়।
(গ) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত মনে করেন, ‘তাকিয়া’ কেবল কাফিরদের বিরুদ্ধে সম্পাদন করা যাবে। অপরদিকে ‘রাফিযী’ সম্প্রদায় এটাকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকেন। (ইসলাম সুয়াল-জাওয়াব পেইজ থেকে) ।
৪। মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক স্বার্থ রক্ষার জন্য কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করা জায়েজ নেই। ‘হাতিব ইবনু আবি বালতা’ নামক সাহাবী তার পারিবারিক স্বার্থ রক্ষার জন্য ‘জুয়াইনা’ নামক মহিলার মাধ্যমে মক্কার মুশরিকদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে মুসলিম উম্মাহর গোপন কিছু বিষয় জানাতে চাইলে আল্লাহ তায়ালা তাৎক্ষণিক জিবরীল (আ.) এর মাধ্যমে এ বিষয় রাসূলুল্লাহ (সা.) কে অবগত করালে তিনি আলী, আবু মারসাদ এবং যুবায়ের ইবনু আওয়াম (রা.) কে পাঠিয়ে ‘রাওদাতু খাখ’ নামক জায়গা থেকে ঐ মহিলাকে আটক করে নিয়ে আসেন। এ বিষয়ে লম্বা একটি হাদীস সহীহ বুখারীর (৩০০৭) এবং সহীহ মুসলিমের (১৬১) নাম্বারে বর্ণিত হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/২০২) ।
৫। কোরআন কারীমের মোট সাতটি আয়াতে (সূরা আলে-ইমরান: ২৮, ১১৮/ সূরা নেসা: ১৪৪/ সূরা মায়িদা: ৫১/ সূরা আনফাল: ৭৩/ সূরা মুযাদালাহ: ২২/ সূরা মুমতাহেনা: ১) কাফিরদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বা অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। ইমাম ওয়হাবা জুহাইলী (র.) বলেছেন: নিম্নের বিষয়গুলো উল্লেখিত আয়াতাবলীতে প্রদত্ব নিষেধের আওতায় পড়বে না:
(ক) জনকল্যানের স্বার্থে মুসলিম ও কাফিরের মধ্যে সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া; কারণ বনী খুজায়া মুশরিক থাকা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের সাথে সন্ধি-চুক্তি করেছিলেন।
(খ) স্বাভাবিক অবস্থায় অমুসলিমদের সাথে প্রতিবেশী হিসেবে সৌজন্যবোধ বা বন্ধুসুলভ আচরণ করা।
(গ) স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে অমুসলিমদের সাথে এমন বিষয়ে বন্ধুত্ব করা, মুসলিম উম্মাহের বৃহৎ স্বার্থের সাথে যার সংশ্লিষ্টতা নেই। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/২০৩) ।
(ঘ) দাওয়াতের উদ্দেশ্যে অমুসলিমের সাথে বন্ধুত্ব করা।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) কাফিরদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা, মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সহযোগিতা এবং তাদের আক্বীদা-বিশ্বাসের প্রতি সমর্থন প্রদান পূর্বক তাদেরকে বন্ধু না বানানো।
(খ) কাফেরদের ক্ষতি এড়াতে তাদের সাথে সৌজন্যবোধ বা বন্ধুসুলভ আচরণ করা।
(গ) সামাজিক বিশৃঙ্খলা এড়াতে প্রতিবেশী কাফেরদের সাথে প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করা।

সূরা আলে-ইমরানের (২৬-২৭) আয়াতদ্বয়ের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: আল্লাহর ক্ষমতার স্বীকৃতি ও তার প্রমাণ।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (26) تُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَتُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَتُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَتُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَتَرْزُقُ مَنْ تَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ (27)﴾ [سورة آل عمران: 26-27].

আয়াতদ্বয়ের আলোচ্যবিষয়: আল্লাহর ক্ষমতার স্বীকৃতি ও তার প্রমাণ।

আয়াতদ্বয়ের সরল অনুবাদ:
২৬। বল: হে আল্লাহ! রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, যার থেকে চান রাজত্ব কেরে নেন, যাকে চান সম্মান দান করেন এবং যাকে চান লাঞ্চিত করেন। কেবল আপনারই হাতে সকল কল্যান; নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
২৭। আপনি প্রবেশ করান রাত্রকে দিনের মধ্যে, এবং প্রবেশ করান দিনকে রাত্রের মধ্যে; আর বের করেন জীবিতকে মৃত থেকে এবং বের করেন মৃতকে জীবিত থেকে; আর যাকে চান বিনা হিসেবে রিযিক দেন।

আয়াতদ্বয়ের ভাবার্থ:
যখন নাজরানের মুশরিক এবং আহলে কিতাব রাসূলুল্লাহ (সা.) এর তাওহীদের দাওয়াতকে অস্বীকার করলো, তখন তাকে শান্তনা প্রদানপূর্বক বলা হয়েছে: তিনি যেন আল্লাহর ক্ষমতার কাছে আশ্রয় চান এবং এভাবে তাঁর কাছে দোয়া করেন: হে সকল রাজত্বের মালিক আল্লাহ তায়ালা! আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন ও যার থেকে ইচ্ছা রাজত্ব কেড়ে নেন এবং যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন ও যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন, সকল কল্যান আপনারই হাতে। নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
আপনার ক্ষমতার অন্যতম প্রমাণ হলো: আপনি রাত্রকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান ও দিনকে রাত্রের মধ্যে প্রবেশ করান। যেমন: কখনও রাত্র ছোট হয়ে দিন বড় হয় আবার কখনও দিন ছোট হয়ে রাত্র বড় হয়। আপনি মৃত থেকে জীবন বের করেন ও জীবন থেকে মৃত বের করেন। যেমন: একটি শুক্র বিন্দু থেকে মানুষ সৃষ্টি করে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তাকে মুত্যু দান করেন। আর সৃষ্টি জগতের মধ্যে যাকে ইচ্ছা বিনা হিসেবে রিযিক দান করেন। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩০২, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৩, আল-মোন্তাখাব: ১/৮৮) ।

আয়াতদ্বয়ের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿اللَّهُمَّ﴾ “হে আল্লাহ!”, আয়াতাংশে ‘আল্লাহুম্মা’ শব্দটি মূলে ছিল ‘ইয়া আল্লাহ’, ‘ইয়া’ অক্ষরটি বিলুপ্ত করে তার পরিবর্তে শব্দের শেষে একটি ‘তাশদীদযুক্ত মীম’ সংযুক্ত করাতে ‘আল্লাহুম্মা’ হয়েছে। শব্দটি দোয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে। (সফওয়াতু আল-তাফাসীর, সাবূনী: ১/১৭৬) ।
﴿مَالِكَ﴾ “মালিক”, আরবী ভাষায় দুইটি শব্দ ‘মাালিক’ (মীম এর পরে আলিফের সাথে) এবং ‘মালিক’ (মীম এর পরে আলিফ ব্যতীত) বাংলা ভাষাতেও আমরা মালিক বলেই জানি। তবে শব্দদ্বয় ব্যবহারের ক্ষেত্রে মৌলিক কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ‘মাালিক’ (মীম এর পরে আলিফের সাথে) কোন বস্তুর উপর এমন মালিকানা হওয়াকে বুঝায়, যেখানে তৃতীয় পক্ষ বা শক্তির হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ থাকে না। এ ধরণের ‘মালিকানা’ আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এ কারণে উল্লেখিত শব্দটি কেবল আল্লাহর ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন: সূরা ফাতিহার প্রথম দিকে ‘মাালিক’ শব্দটি আল্লাহ তায়ালার বিচার দিনের একক মালিকানা হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে। অত্র ছাব্বিশ নাম্বার আয়াতেও আল্লাহ তায়ালা রাজত্বের একক মালিক হওয়া অর্থে ব্যবহার হয়েছে।
(খ) ‘মালিক’ (মীম এর পরে আলিফ ব্যতীত) কোন বস্তুর উপর এমন মালিকানা হওয়াকে বুঝায়, যেখানে তৃতীয় পক্ষ বা শক্তির হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকে। এ ধরণের ‘মালিকানা’ আল্লাহ তায়ালা এবং অন্য যে কোন সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এ কারণে উল্লেখিত শব্দটি আল্লাহ তায়ালা এবং মানুষ উভয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন: সূরা নাস এর প্রথম দিকে ‘মালিক’ শব্দটি আল্লাহর ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে। দুনিয়ার রাজা-বাদশাহের ক্ষেত্রে উক্ত শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে, যেমন: সৌদিআরবের বাদশাহদেরকে ‘মালিক’ বলা হয়।
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, ‘মাালিক’ শব্দটি ‘খাস’ বা বিশেষ অর্থবোধক, যা কেবল আল্লাহ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। অপরদিকে ‘মালিক’ শব্দটি ‘আম’ বা ব্যাপক অর্থবোধক, যা আল্লাহ এবং মানুষ উভয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। (মুজাম আল-ফুরূক আল-লুগউইয়্যাহ, আল-আসকারী: ১/৪৭৩-৪৭৪) ।
সুতরাং উল্লেখিত আয়াতাংশে ইঙ্গিত রয়েছে যে, পুরো ইউনিভার্স একটি রাজত্বের শামিল, যার একচ্ছত্র মালিকানা কেবল আল্লাহ তায়ালার জন্য। সেখান থেকে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের অধিকারী মানুষকে বানিয়ে থাকেন তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য।
﴿الْمُلْكِ﴾ “রাজত্ব”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ ব্যাপারে ফখরুদ্দীন আল-রাযী (র.) বলেন: এখানে মালিকানা দ্বারা সকল ধরনের মালিকানাকে বুঝানো হয়েছে। যেমন: রাজত্বের মালিক বানানো, নবুয়াতের মালিক বানানো, জ্ঞানবুদ্ধির মালিক বানানো, সুস্থতার মালিক বানানো, ধনসম্পদের মালিক বানানো ইত্যাদি। (আল-তাফসীর আল-কাবীর: ৮/১৮৯) ।
﴿بِيَدِكَ الْخَيْرُ﴾ “সকল কল্যাণ আপনারি হাতে”, আয়াতের আগে পরের বর্ণনাভঙ্গির আলোকে আয়াতাংশের অর্থ হবে: “আপনার হাতে সকল কল্যাণ ও অকল্যাণ, যাকে ইচ্ছা কল্যাণ দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা অকল্যাণ দান করেন”। (আইসার আল-তাফাসীর, ১/৩০৪) ।
﴿وَتُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ﴾ ‘আর আপনি মৃত থেকে জীবন বের করেন’, তাফসীরকারকগণ এ আয়াতাংশের তিনটি ব্যাখ্যা করেছেন:
(ক) জাগতিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত, যেমন: বীজ থেকে উদ্ভিদ উৎপাদন হওয়া, শুক্রাণু থেকে মানুষ সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি।
(খ) আধ্যাত্মিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত, যেমন: কাফের থেকে মুমিন হওয়া, মুর্খ থেকে জ্ঞানী হওয়া ইত্যাদি।
(গ) জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয়ের সাথে সম্পৃক্ত, যেমন: বীজ থেকে উদ্ভিদ উৎপাদন হওয়া, শুক্রাণু থেকে মানুষ সৃষ্টি হওয়া, কাফের থেকে মুমিন হওয়া, মুর্খ থেকে জ্ঞানী হওয়া ইত্যাদি।
এছাড়াও কতিপয় চিকিৎসাবিজ্ঞানী মনে করেন, আয়াতে ‘হাইয়্য’ দ্বারা প্রাণীজগতকে বুঝানো হয়েছে এবং ‘মাইয়্যেত’ দ্বারা তাদের খাবারকে বুঝানো হয়েছে। যেমন: মানুষ ভাত, গোস্ত, সবজী ইত্যাদি খেয়ে বৃদ্ধি পায়। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/১৯৫)।
উল্লেখিত সবগুলো মতকেই এখানে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, কারণ আয়াতে ব্যাপকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, কোনটাকে খাস করা হয়নি।
﴿وَتُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ﴾ ‘এবং আপনি জীবন থেকে মৃত বের করেন’, অত্র আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় তাফসীরকারকগণ বলেন: জীবিত প্রানী থেকে যা বের হয়, যেমন: দুধ, গোস্ত, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/১৯৫)।

উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
উনিশ থেকে পচিশ নাম্বার আয়াতে নাজরান, মক্কা এবং মদীনার আহলে কিতাব ও মুশরিকদের মাঝে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দাওয়াতী কার্যক্রম এবং তাদের প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর উল্লেখিত (২৬-২৭) আয়াতদ্বয়ে যে কোন কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হলে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে মহা ক্ষমতাধর আল্লাহর কাছে আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে তাঁর পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে শান্তনা প্রদান করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৩০-১৩১) ।

(২৬-২৭) আয়াতদ্বয় অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: মক্কা বিজয়ের দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদেরকে তৎকালীন দুই পরাশক্তিধর দেশ রোম ও পারস্য বিজয়ের সুসংবাদ দিলে ইহুদী ও মোনাফেকরা ব্যঙ্গ করে বলতে থাকে এ তো ফকীরের বিছানায় লক্ষ টাকার স্বপ্ন দেখার মতো। কোথায় মোহাম্মদ আর কোথায় রোম-পারস্য!। মোহাম্মদ মক্কা-মদীনা নিয়ে আছে তাই তো অনেক, আবার রোম-পারস্য বিজয়ের দুঃস্বপ্ন। তাদের এ ব্যঙ্গাত্বমূলক কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াতদ্বয় অবতীর্ণ করে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে শান্তনা প্রদান করেছেন। (আসবাবুন নুযূল, ওয়াহেদী: ১/১০২) ।

ছাব্বিশ নাম্বার আয়াতের ফযীলত:
অত্র আয়াতে আল্লাহ তায়ালার ‘ইসমে আযম’ রয়েছে, এর দ্বারা কোন দোয়া করলে আল্লাহ তায়ালা তা সরাসরি কবুল করে নেন। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
اسْمُ اللهِ الأَعْظَمُ الَّذِي إِذَا دُعِيَ بِهِ أَجَابَ فِي هَذِهِ الآيَةِ مِنْ آلِ عِمْرَانَ: ﴿قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمَلِكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ﴾ إِلَى آخِرِهِ. (المعجم الكبير للطبراني: ১২৭৯২).
অর্থাৎ: সূরা আলে-ইমরানের একটি আয়াতে আল্লাহর ‘ইসমে আযম’ রয়েছে, এ আয়াত দিয়ে দোয়া করলে আল্লাহ তা সরাসরি কবুল করে নেন। আয়াতটি হলো: আলে-ইমরানের ছাব্বিশ নাম্বার আয়াত। (মুযাম আল-কাবীর লিততাবরানী: ১২৭৯২) ।

আয়াতদ্বয়ের শিক্ষা:
১। ছাব্বিশ নাম্বার আয়াত থেকে কয়েকটি শিক্ষা রয়েছে:
(ক) বান্দা তার সকল বিষয়কে আল্লাহ তায়ালার দিকে সোপর্দ করবে; কারণ আয়াতে দেখা যায় আল্লাহ তায়ালা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সম্বোধন করে মানবজাতিকে তাদের সকল বিষয়কে কেবল তাঁর দিকে সোপর্দ করতে বলেছেন।
(খ) সব কিছুর পরিপূর্ণ অধিকারিত্ব একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য; কারণ আয়াতের কয়েকটি অংশে বলা হয়েছে: তিনি যাকে ইচ্ছা মালিকানা দেন ও যার থেকে ইচ্ছা মালিকানা নিয়ে নেন এবং তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন ও যাকে ইচ্ছা লাঞ্চিত করেন।
(গ) এ মহাবিশ্বে আল্লাহর ইচ্ছার বাহিরে কোন কিছুই সংগঠিত হয় না। এ সম্পর্কে কোরআনে অনেক আয়াত রয়েছে, যেমন: সূরা দাহ্র এর ত্রিশ নাম্বার আয়াত, সূরা তাকভীর এর উনত্রিশ নাম্বার আয়াত এবং সূরা আল-আনয়াম এর ১৩৪ নাম্বার আয়াত উল্লেখযোগ্য।
এ শিক্ষার বাস্তবতা সচরাচার আমাদের চোখে পড়ে, যেমন: মানুষের ক্ষমতার পালাবদল, সম্মানের জায়গায় বসিয়ে সেখান থেকে লাঞ্চিত করে বের করে দেওয়া ইত্যাদি। (তাফসীর আল-কোরআন আল-কারীম, সালিহ আল-উসাইমিন: ৩/১৬০-১৬৩) ।
২। সাতাইশ নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় সব কিছুর উপর পরিপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তায়ালা এবং তিনিই সবাইকে রিযিক দান করেন; কারণ আয়াতের কয়েকটি অংশে বলা হয়েছে: তিনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান ও দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান, তিনি মৃত থেকে জীবন ও জীবন থেকে মৃত বের করেন এবং যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন। (তাফসীর আল-কোরআন আল-কারীম, সালিহ আল-উসাইমিন: ৩/১৬৭-১৬৮) ।
৩। উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে দৈনন্দিন কাজকর্মে তাওহীদ বা একত্বাবাদ কেমন হবে, তা শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন: শক্তিসমর্থ, ইজ্জতসম্মান, ধনসম্পদ, জ্ঞানবুদ্ধি ইত্যাদি সবকিছুই কেবল আল্লাহ তায়ালার কাছে চাওয়া যায়, অন্য কারো কাছে নয়।
৪। রাসূলুল্লাহ (সা.) কাফির-মুশরিক ও আহলেকিতাবের আচরণে মনঃক্ষুন্ন হলে উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাকে শান্তনা প্রদান করেছেন।

আয়াতাদ্বয়ের আমল:
(ক) সম্মান কেবল আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করা, তিনি চাড়া অন্য কারো কাছে সম্মান চাইলে লাঞ্চিত হতে হয়।
(খ) জীবনে লাঞ্চিত হওয়া থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থণা করা।
(গ) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে রিযিক তালাশ না করা।

সূরা আলে-ইমরানের (২৩-২৫) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: আল্লাহর বিধান থেকে আহলে কিতাবের বিমুখ হওয়ার কারণ ও পরিণাম ।

By দৈনিক তাফসীর One Comment

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُدْعَوْنَ إِلَى كِتَابِ اللَّهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ يَتَوَلَّى فَرِيقٌ مِنْهُمْ وَهُمْ مُعْرِضُونَ (23) ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَنْ تَمَسَّنَا النَّارُ إِلَّا أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ وَغَرَّهُمْ فِي دِينِهِمْ مَا كَانُوا يَفْتَرُونَ (24) فَكَيْفَ إِذَا جَمَعْنَاهُمْ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ وَوُفِّيَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ  (25) [سورة آل عمران: 23-25]

 

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: আল্লাহর বিধান থেকে আহলে কিতাবের বিমুখ হওয়ার কারণ ও পরিণাম ।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
২৩। তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যাদেরকে প্রদান করা হয়েছে কিছু অংশ কিতাব থেকে? তাদেরকে ডাকা হয় আল্লাহর কিতাবের দিকে মিমাংসার জন্য তাদের মধ্যে; অতঃপর ফিরে যাচ্ছে তাদের একটি দল বিমুখ হয়ে।
২৪। এর কারণ হলো: তারা বলে থাকে আমাদেরকে স্পর্শ করবে না জাহান্নাম গুটি কয়েক দিন ছাড়া; আর তাদেরকে প্রতারিত করেছে তাদের দ্বীনের ব্যাপারে তারা যা মিথ্যা রচনা করতো।
২৫। সুতরাং কি অবস্থা হবে যখন আমি তাদেরকে একত্র করবো এমন দিনের জন্য যে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই; আর পরিপূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে প্রত্যেককে যা সে অর্জন করেছে, তারা যুলমের স্বীকার হবে না।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
কোরআনকে অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আহলে কিতাবের অস্বীকৃতি, গোমরাহী এবং হটকারিতা দেখে রাসূলুল্লাহকে (সা.) বিস্ময় প্রকাশ না করতে আল্লাহ তায়ালা উপদেশ দিয়েছেন; কারণ এটা তাদের চিরাচরিত অভ্যাস। যখনই তাদের কাছে হিদায়াত ও ফয়সালাকারী কিতাব এসেছে, তখনই তারা তা অস্বীকার করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
হিদায়াত থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ হলো:
(ক) তাদের ভ্রান্তবিশ্বাস, তারা মনে করে জাহান্নাম তাদেরকে গুটি কয়েকদিন স্পর্শ করবে।
(খ) দ্বীনের ব্যাপারে মিথ্যাচারিতা, যা তদেরকে বোকা বানিয়ে রেখেছে।
সেদিন তাদের কি অবস্থা হবে, যেদিন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বিচারের জন্য একত্র করবেন, যে ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আর সেদিন প্রত্যেককে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে প্রদান করা হবে, কারো প্রতি বিন্দুমাত্র যুলম করা হবে না। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩০২, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৩, আল-মোন্তাখাব: ১/৮৭) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ﴾ “যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে”, আয়াতাংশে ‘কিতাব দ্বারা ‘তাওরাত’ কে বুঝানো হয়েছে। সূতরাং উল্লেখিত আয়াতাংশ দ্বারা ইহুদীদেরকে বুঝানো হয়েছে।
﴿إِلَى كِتَابِ اللَّهِ﴾ “আল্লাহর কিতাবের দিকে”, আয়াতাংশে ‘কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য হলো:
(ক) ‘তাওরাত’, আয়াতের অর্থ হবে: মূসা (আ.) ইহুুদীদেরকে তাওরাতের দিকে আহবান করলে, তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল, এতে আপনার বিস্ময় হওয়ার কিছু নেই।
(খ) ‘কোরআন’, আয়াতের অর্থ হবে: আপনি তাদেরকে কোরআনের দিকে আহবান করলে, তা তারা প্রত্যাখ্যান করেছে, এতে আপনার বিস্ময় হওয়ার কিছু নেই। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা আল-জুহাইলী: ৩/১৮৮) ।
﴿أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ﴾ “গুটি কয়েকদিন”, আয়াতাংশে ‘গুটি কয়েকদিন’ উদ্দেশ্য কি? এ ব্যাপারে অধিকাংশ তাফসীরকারকদের মত হলো: ‘গুটি কয়েকদিন’ দ্বারা সাত দিনকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ: ইহুদীরা বিশ্বাস করতো তাদেরকে মাত্র সাত দিন জাহান্নামের শাস্তি দেওয়া হবে।
তবে সাত দিনকে নির্ধারণ করার কারণ সম্পর্কে তাফসীরকারকদের কয়েকটি মত পাওয়া যায়:
(ক) তারা সাত দিন গো বৎসের পুজা করেছিল।
(খ) পৃথিবীর বয়স সাত হাজার বছর, প্রতি হাজার বছরের জন্য এক দিন করে জাহান্নামের শাস্তি দেওয়া হবে। সুতরাং এ হিসেবে মোট সাত দিন হয়। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (র.) দুইটি কারণকেই দুর্বল মনে করেন। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৩/৫৬৬) ।
﴿لِيَوْمٍ﴾ “এমন দিনের জন্য”, আয়াতাংশে ‘দিন’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ ব্যাপারে সকল তাফসীরকারক একমত যে, এর দ্বারা কিয়ামতের দিনকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১২৬) ।

উল্লেখিত আয়াতবলীর সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্ববর্তী আয়াতাবলীতে ইহুদীদের ঘৃণ্য আচরণ বর্ণনার পর উল্লেখিত আয়াতাবলীতেও রাসূলুল্লাহকে (সা.) সম্বোধন করে তাদের কিছু কুৎসিত এবং হীন আচরণ এমন ভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে, যা বিস্ময়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। (আল-মুনীর: ৩/১৮৮)।

(২৩-২৪) আয়াতদ্বয় অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) ইহুদীদের মাদ্রাসায় একদল ইহুদীদের কাছে প্রবেশ করে তাদেরকে তাওহীদের দিকে আহবান করলেন।
অতঃপর নাঈম ইবনু আমর এবং হারিস ইবনু যায়েদ নামক দুইজন ইহুদী তাকে বললো: হে মোহাম্মদ! তুমি কোন ধর্মের অনুসারী?
রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বললেন: আমি ইব্রাহীম (আ.) এর ধর্মের অনুসারী।
তখন তারা বললো: ইব্রাহীম (আ.) তো ইহুদী ছিলেন।
অতঃপর তিনি তাদেরকে বললেন: তাহলে তাওরাতের দিকে এসো; কারণ তা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান। এতে তারা অস্বীকৃতি জানালে আল্লাহ তায়ালা অত্র সূরার (২৩-২৪) নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করেন। (লুবাব আল-নুক‚ল, সুয়ূতী: ৬১) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। তেইশ নাম্বার আয়াতের প্রথমাংশ দ্বারা বুঝা যায় ইসলামী বিধান অনুসরণ করা ওয়াজিব। অত্র সূরার (১৯, ৮৩, ৮৫) নাম্বার আয়াতে ইসলামকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবনবিধান বলা হয়েছে। কোরআন কারীমে ইসলামী বিধান সম্পর্কিত মোট ৫০০টি আয়াতের সতন্ত্র তাফসীর গ্রন্থ রয়েছে। যেমন: জাসাাস আল-হানাফী (র.), ইবনুল আরাবী আল-মালিকী (র.) এর লিখিত তাফসীর। ইমাম কুরতুবী (র.) এর লিখিত তাফসীর গ্রন্থেও বিধান সম্পর্কিত আয়াতাবলীকে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়াও আধুনিক সময়ে আলী আল-সাবুনী (র.) এর লেখা তাফসীরও প্রশিদ্ধি লাভ করেছে।
২। তেইশ এবং চব্বিশ নাম্বার আয়াতে ইহুদীদের দুইটি আচরণকে নিন্দা করা হয়েছে:
(ক) কিতাব এবং রাসূলুল্লাহকে (সা.) অনুসরণ না করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।
(খ) আখেরাতে একটি নির্ধারিত সময়ের পরে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা পোষণ করা।
৩। তেইশ নাম্বার আয়াত থেকে ইমাম মালিক (র.) একটি মাসয়ালা নির্গত করেছেন: পূর্ববর্তী শরিয়তে যা রহিত করা হয়েছে, তা ছাড়া বাকী সকল বিধানই আমাদের জন্য অনুসরণীয়। তবে তাওরাত-ইনজীলের ক্ষেত্রে ভিন্ন হুকুম, কারণ তা ইহুদী-খৃষ্টানদের হাতে নিরাপদ ছিল না।
৪। চব্বিশ নাম্বার আয়াতে হিদায়াত থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার দুইটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে:
(ক) তাদের ভ্রান্তবিশ্বাস, তারা মনে করে জাহান্নাম তাদেরকে গুটি কয়েকদিন স্পর্শ করবে।
(খ) দ্বীনের ব্যাপারে মিথ্যাচারিতা, যা তদেরকে বোকা বানিয়ে রেখেছে।
৫। চব্বিশ এবং পচিশ নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায়, আখেরাতে ব্যক্তি, দল এবং বংশমর্যাদা কোন কাজে আসবে না, মানুষের আমলই মুক্তির একমাত্র পাথেয় হবে।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) কোন ব্যক্তি, দল এবং বংশ পরিচয়ে জান্নাতে জাওয়ার ইচ্ছা লালন না করা, যা ইহুদীরা করে থাকে।
(খ) ইসলামী বিধি-বিধানের দিকে ডাকা হলে সারা দেওয়া।

 

সূরা আলে-ইমরানের (২১-২২) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: নবী-রাসূল ও আলেম-ওলামাদের প্রতি যুলমের পরিণতি।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَيَقْتُلُونَ الَّذِينَ يَأْمُرُونَ بِالْقِسْطِ مِنَ النَّاسِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ (21) أُولَئِكَ الَّذِينَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ (22)﴾ [سورة آل عمران: 21-22]

আয়াতদ্বয়ের আলোচ্যবিষয়: নবী-রাসূল ও আলেম-ওলামাদের প্রতি যুলমের পরিণতি।

আয়াতদ্বয়ের সরল অনুবাদ:
২১। নিশ্চয় যারা আল্লাহর আয়াতাবলীর সাথে কুফরী করে এবং নবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, এবং তাদেরকে হত্যা করে, মানুষের মধ্য থেকে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয়; আপনি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দিন।
২২। ওরাই হলো তারা, যাদের আমলসমূহ নিষ্ফল হয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে এবং তাদের কোন সাহায্যকারী নেই।

আয়াতদ্বয়ের ভাবার্থ:
নিশ্চয় যারা মহাজাগতিক এবং প্রেরিত আয়াতকে অস্বীকার করে এবং তাদের হিদায়াতের জন্য প্রেরিত নবী-রাসূলদেরকে অন্যায়ভাবে অত্যাচারপূর্বক হত্যা করে, এমনকি মানুষের মধ্য থেকে যে সকল ওলামায়ে কেরাম তাদেরকে ন্যায়পরায়ণতার দিকে আহবান করে তাদেরকেও ভৎসনা ও হত্যা করে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলের (সা.) মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের জন্য তিনটি ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে:
(ক) তাদের জন্য জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।
(খ) তাদের কৃত সৎআমলগুলো বাতিল হয়ে যাবে।
(গ) যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রক্ষা করার জন্য আখেরাতে কোন সাহায্যকারী পাবে না। (আইসার আল-তাফসীর: ১/২৯৯-৩০০, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫২, আল-মোন্তাখাব: ১/৮৭) ।

আয়াতদ্বয়ের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ﴾ “যারা আল্লাহর আয়াতাবলীকে অস্বীকার করে এবং নবীদেরকে হত্যা করে”, আয়াতাংশে ‘যারা’ দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? এ ব্যাপারে কয়েকটি মত পাওয়া যায়:
(ক) ইমাম বায়দাভী (র.) বলেন: পূর্ববর্তী যুগের ও রাসূলুল্লাহর (সা.) সমসাময়ীক আহলে কিতাবকে বুঝানো হয়েছে, যারা পূর্ববর্তী অনেক নবীকে হত্যা করেছে এবং রাসূলুল্লাহকে (সা.) হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছে। (তাফসীর আল-বায়দাভী: ২/১০) ।
(খ) ইমাম নাসাফী (র.) বলেন: সকল আহলে কিতাবকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-নাসাফী: ১/২৪৪) ।
(গ) ইমাম মারাগী (র.) বলেন: ইহুদীদেরকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১২২) ।
উল্লেখিত অভিমতগুলোকে সমন্বয় করে বলা যায়, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল কাফের মুশরিকদেরেকে ব্যাপকভাবে বুঝানো হয়েছে, যারা পূর্বে নবী-রাসূল ও তাদের অনুসারীদেরকে হত্যা করেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা এ চরিত্রের অধিকারী হবে; কারণ আয়াতে দুইটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) আয়াতে ‘আল্লাযিনা’ তথা ‘যারা’ শব্দটি ব্যাপক অর্থের ফায়দা দেয়।
(খ) আয়াতে ‘ফিল আল-মুদারি’ তথা ‘বর্তমান ও ভবিষ্যত সূচক ক্রিয়া’ ব্যবহার করা হয়েছে, যা ‘দাওয়াম’ তথা ‘সর্বদা সংগঠিত হওয়ার’ ফায়দা দেয়। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
(১৯-২০) নাম্বার আয়াতে রাসূলুল্লাহর (সা.) সমসাময়ীক ইহুদীদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে, যারা তার প্রতি হিংসার কারণে ইসলাম নিয়ে মতবিরোধ করতো এবং তার সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হতো। আর অত্র আয়াতদ্বয়ে, তাদের এবং তাদের পিতৃপুরুষ ইহুদীদের হিং¯্র চরিত্র ও তার ভয়াবহ পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। তারা রাসূলুল্লাহকে (সা.) হত্যার চেষ্টা করেছিল আর তাদের পিতৃপুরুষ ইহুদীরা তৎকালীন নবী-রাসূলদেরকে হত্যা করতো। সুতরাং উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের সাথে পূর্বের আয়াতের সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মারাগী: ১২২-১২৩) ।

(২১-২২) নাম্বার আয়াতসংশ্লিষ্ট ঘটনা:
আবু আব্বাস আল-মুবাররাদ (র.) বলেন: বনী ইসরাইলদের কাছে নবী-রাসূল আসলে, তারা তদের প্রতি অত্যাচার করে হত্যা করতো; এমনকি তাদের মধ্য থেকে কেউ তাদেরকে নসীহত করলে তাদেরকেও হত্যা করা হতো। অত্র আয়াতদ্বয়ে এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে।
আবু উবায়দা ইবন আল-জাররাহ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: বনী ইসরাইলরা ৪৩ জন নবী-রাসূলদেরকে দিনের দ্বিপ্রহরের পূর্বে এক ঘন্টার ব্যাবধানে হত্যা করেছিল। অতঃপর তাদের নিজেদের মধ্য থেকে একদল তাদেরকে ভালো কাজের আদেশ করলে, তাদের মধ্য থেকে ১১২ জনকে দিনের শেষ প্রহরে হত্যা করেছিল। অত্র আয়াতদ্বয়ে এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। (তফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৪৬, তাফসীর আল-মুনীর: ৩/১৮৪)।

আয়াতদ্বয়ের শিক্ষা:
১। উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ে তিনটি গুণের মানুষের জন্য তিন প্রকার শাস্তির বর্ণনা রয়েছে। তিনটি গুণের মানুষ হলো:
(ক) যারা আল্লাহর মহাজাগতিক ও প্রেরিত আয়াতাবলীকে অস্বীকার করে।
(খ) যারা নবী-রাসূলদেরকে গালমন্দ ও হত্যা করে।
(গ) হক্কানী ওলামায়ে কেরামকে (যারা মানুষকে সৎকাজের আদেশ করে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে) গালমন্দ ও হত্যা করে।
এবং উল্লেখিত তিনটি গুণের যেকোন একটি গুণ কারো মধ্যে পাওয়া গেলে তার জন্য নি¤েœর তিনটি শাস্তি অবধারিত:
(ক) তাদের জন্য জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।
(খ) তাদের সৎআমল দুনিয়া ও আখেরাতে বরবাদ হয়ে যাবে।
(গ) জাহান্নাম থেকে বাচানোর জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা আল-জুহাইলী: ৩/১৮৬-১৮৭) ।

২। একুশ নাম্বার আয়াতে ‘আল্লাহর আয়াতাবলী’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো:
(ক) আল্লাহর ‘মহাজাগতিক নিদর্শন’ অর্থাৎ: সৃষ্টি জগতের বিচিত্র সৃষ্টি।
(খ) কোরআনে বর্ণিত আল্লাহর আয়াতাবলী। (আল-মোন্তাখাব, ওলামায়ে আযহার: ১/৮৭)।
ইমাম মওদুদী (র.) প্রথম প্রকার আয়াতকে আল্লাহর প্রাক্টিক্যাল বা ব্যবহারিক নিদর্শন বলেছেন এবং দ্বিতীয় প্রকারকে আল্লাহর থিওরিক্যাল বা তাত্বিক নিদর্শন বলেছেন।
আয়াতে বর্ণিত ‘আয়াাত’ শব্দটি বহুবচন এবং ব্যাপকভাবে বর্ণিত হওয়ার কারণে বলা যায়: উল্লেখিত দুই প্রকার আল্লাহর আয়াতের যেকোন একটিকে কেউ অস্বীকার করলে, সে কাফির হয়ে যাবে। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

৩। একুশ নাম্বার আয়াতে ‘তারা নবীদেরকে হত্যা করেছে’, একই অর্থে সূরা বাক্বারা এর ৬১ ও ৮৭ নাম্বার আয়াত এবং সূরা আলে ইমরান এর ২১ নাম্বার আয়াত এসেছে। বনুইসরাঈলরা কতজন নবীকে হত্যা করেছে? এ ব্যাপারে ৪৩ জনের একটি সংখ্যা বিভিন্ন হাদীসে পাওয়া গেলেও তারা যেসকল নবী-রাসূলদেরকে হত্যা করেছে, তাদের নামের কোন তালিকা পাওয়া যায় না, তবে তাফসীরকারকগণ কয়েকজন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। ইমাম বায়যাভী (র.) তার তাফসীর গ্রন্থে বলেন: বনুইসরাঈলরা যাকারিয়া (আ.) এবং ইয়াহইয়া (আ.) কে হত্যা করেছে। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ১/৯৩) ।

৪। একুশ নাম্বার আয়াতে আরো বলা হয়েছে: ‘তারা অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে’, এখন প্রশ্ন হতে পারে, এ আয়াতাংশ দ্বারা বুঝা যায় নবীদেরকে হত্যা করার ন্যায্য কোন রুপ আছে। তাহলে আয়াতাংশ দ্বারা কি উদ্দেশ্য করা হয়েছে?
ইমাম নাসাফী (র.) বলেন: এখানে আয়াতাংশ দ্বারা তাদের অন্যায় কর্মের ভয়াবহতার উপর তাগিদ দিয়েছেন। অর্থাৎ নবী-রাসূলদেরকে হত্যা করাটাইতো অন্যায়, পুণরায় আবার ‘অন্যায়ভাবে’ শব্দটি যোগ করে তারা অন্যায়ের চুড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছে তার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (তাফসীর আল-নাসাফী: ১/২৪৪) ।

৫। একুশ নাম্বার আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে: যারা মানুষকে ন্যায়পরাণতার আদেশ দিতো, তাদেরকেও ইহুদীরা হত্যা করেছিল। ন্যায়পরায়ণতার দিকে আদেশ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা’, যা সকল যুগের উম্মতের উপর ওয়াজিব ছিল এবং বর্তমানে উম্মতে মোহাম্মাদীর উপরেও ওয়াজিব। দুইটি কারণে এর গুরুত্ব বেড়েছে:
(ক) এর মাধ্যমে নুবুয়াতের প্রতিনিধিত্ব হয়, যেমন: ওবাদা ইবনু সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“مَنْ أَمَرَ بِالْمَعْرُوْفِ أَوْ نَهَى عَنِ الْمُنْكَرِ، فَهُوَ خَلِيْفَةُ اللهِ فِيْ أَرْضِهِ، وَخَلِيْفَةُ رَسُوْلِهِ، وَخَلِيْفَةُ كِتَابِهِ” (السلسلة الضعيفة للألباني: ৪৮৪০).
অর্থাৎ: “যে ব্যক্তি সৎকাজের আদেশ করে অথবা অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে, সে আল্লাহর যমীনে তাঁর খলীফা, তাঁর রাসূলের (সা.) খলীফা এবং তাঁর কিতাবের খলীফা” (আল-সিলসিলা আল-যয়ীফা, নাসিরুদ্দীন আলবানী: ৪৮৪০) । হাদীসের মান যয়ীফ।
(খ) ‘সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ’ মুমিন ও মুনাফিকের মধ্যে পার্থক্য করার মানদন্ড; কারণ মুমিন সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে, অপরদিকে মুনাফিক সৎকাজ থেকে নিষেধ করে এবং অসৎকাজের আদেশ করে। এ সম্পর্কে সূরা তাওবা এর ৬৭ এবং ৭১ নাম্বার আয়াতে বর্ণনা এসেছে।
(গ) মুসলিম জাতি সর্বোত্তম হওয়ার মূল ভিত্তি হলো: ‘সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ’। সূরা আলে-ইমরান এর ১১০ নাম্বার আয়াতে এসেছে:
﴿كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ﴾ [سورة آل عمران: ১১০].
অর্থাৎ: “তোমরা হচ্ছো সর্বোত্তম জাতি, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদেরকে বের করে আনা হয়েছে। তোমাদের দায়িত্ব হলো: তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে” (সূরা আলে-ইমরান: ১১০) ।
উল্লেখ্য যে, ‘সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ’ এর ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় লক্ষনীয়:
(ক) ‘সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ’ এর ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে ন্যায়পরায়ণকারী হওয়া শর্ত নয়, বরং এ দায়িত্ব ব্যাপকভাবে সবার জন্য প্রযোজ্য হবে।
(খ) মানুষ তার জ্ঞানগত ও সামাজিক সক্ষমতা অনুযায়ী সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। যার প্রশাসনিক ক্ষমতা আছে, সে তা ব্যবহার করে এ কাজের আঞ্জাম দিবে। যার প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই, কিন্তু মুখ দিয়ে দাওয়াত দিয়ে টিকে থাকার মতো সক্ষমতা রয়েছে, সে আলোচনা সভা, সেমিনার, কনফারেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে এ মহৎকাজের আঞ্জাম দিবে। আর যার উপরের দুইটির কোনটার সক্ষমতা নেই, সে মনে মনে ঘৃণা করবে এবং পরিবর্তনের জন্য পরিকল্পনা করবে। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ” (صحيح مسلم: ১৮৬).
অর্থাৎ: “তোমাদের কেউ খারাব কাজ সংগঠিত হতে দেখলে সে যেন তা তার হাত দিয়ে প্রতিহত করে; যদি হাত দিয়ে প্রতিহত করতে সক্ষম না হয়, তাহলে যেন নসীহত করার মাধ্যমে তা প্রতিহত করে; যদি নসিহত করার মতো পরিস্থিতি না থাকে, তাহলে তা অন্তরে ঘৃণা করে পরিবর্তনের পরিকল্পনা করবে। তৃতীয় নাম্বারটি হলো ঈমানের দুর্বল স্তর”। (সহীহ মুসলিম: ১৮৬) । ওয়হাবা আল-জুহাইলী তার তাফসীর গ্রন্থে বলেন: এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ওলামায়ে কেরাম বলেন: কোন অপরাধ সংগঠিত হতে দেখলে প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ হাত দিয়ে প্রতিহত করবে, ওলামায়ে কেরাম প্রতিহত করবে নসিহত করার মাধ্যমে এবং সাধারণ দুর্বল মানুষ তা অন্তর থেকে ঘৃণা করবে। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/১৮৬) ।

৬। বর্তমান প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের মৌলিক শিক্ষা হলো: যারা নবী-রাসূল এবং ওলামায়ে কেরামকে গালমন্দ ও হত্যা করে, তাদের জন্য ভয়াবহ তিন প্রকার শাস্তি অবধারিত রেখেছেন। এজন্য আমাদেরকে খুব বেশী সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, আমরা যেন নি¤েœর যে কোন একটি দলের অন্তর্ভূক্ত না হই।
(ক) মুসলিম নামধারী নাস্তিক, যারা সর্বদা নবী-রাসূল ও বর্তমান সময়ের অহীর ধারকবাহক ওলামায়ে কেরামের পিছনে লেগে থাকে। একটু সুযোগ পেলেই তাদেরকে ঘায়েল করতে আর বিলম্ব করে না।
(খ) কিছু মডার্ণ মুসলিম, যারা আলেমদের আচার-আচরণ ও চালচলনকে বর্তমান সময়ের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করার কারণে তাদেরকে নিয়ে উপহাস করে থাকে।
(গ) ইসলাম বিদ্বেষী একটি বিশাল অংশ, যারা সর্বদা রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং আলেম-ওলামাদেরকে নিয়ে কটাক্ষ করতে সোচ্চার থাকে। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

আয়াতদ্বয়ের আমল:
(ক) নবী-রাসূলদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা এবং ওলামায়ে কেরামকে যথাযোগ্য সম্মান ও তাদের সাথে ভালো আচরণ করা।
(খ) সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা।

সূরা আলে-ইমরানের (১৮-২০) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: একাত্ববাদী আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র দ্বীন হলো ইসলাম।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (18) إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَنْ يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ (19) فَإِنْ حَاجُّوكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلَّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ وَقُلْ لِلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ (20) ﴾ [سورة آل عمران: 18-20].

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: একাত্ববাদী আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র দ্বীন হলো ইসলাম।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
১৮। আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই; আর ফেরেশতাগণ ও জ্ঞানীগণও (একই সাক্ষ্য দেন); তিনি ন্যায়প্রতিষ্ঠাকারী। তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই; তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
১৯। নিশ্চয় (গ্রহণযোগ্য) দ্বীন হচ্ছে আল্লাহর নিকট ইসলাম। মতানৈক্য করে নাই আহলে কিতাবগণ তাদের নিকট জ্ঞান আসার পর ব্যতীত পরস্পর বিদ্বেষবশত। আর যে কুফরী কওে আল্লাহর আয়াতাবলীর সাথে, নিশ্চয় আল্লাহ দ্রæত হিসাব গ্রহণকারী।
২০। অতঃপর যদি তারা তোমার সাথে বিতর্ক করে, তবে বলে দিন: আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি আল্লাহর জন্যে, এবং আমার অনুসারীগণও। এবং বলো আহলেকিতাবদেরকে ও নিরক্ষরদেরকে: তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করেছো? সুতরাং যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তারা অবশ্যই হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে; আর যদি তারা ফিরে যায়, তাহলে তোমার দায়িত্ব শুধু পৌঁছিয়ে দেওয়া; আর আল্লাহ সম্যক দ্রষ্টা বান্দাদের সম্পর্কে।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
নাজরান থেকে আগত খৃষ্টানদের ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস, ইহুদীদের চক্রান্ত এবং কোরাইশ গোত্রের শিরকী কার্যকলাপের জবাব উল্লেখিত আয়াতাবলীতে নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে দেওয়া হয়েছে:
(ক) আল্লাহ তায়ালার একাত্ববাদের স্বপক্ষে নির্ভরযোগ্য তিনটি বস্তুকে সাক্ষী বানানো হয়েছে: তাঁর একাত্ববাদের সাক্ষী তিনি নিজেই, ফেরেশতাগণ এবং বিশেষজ্ঞগন।
(খ) তাঁর একাত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদানের অর্থ হলো একাত্ববাদী ধর্ম ইসলামকে মেনে নেওয়া; কারণ ইসলামই আল্লাহ তায়ালার একমাত্র মনোনীত একাত্ববাদী ধর্ম।
(গ) মোহাম্মদ (সা.) এর প্রতি বিদ্বেষের কারণে ইহুদী-খৃষ্টানরা সঠিক জ্ঞান পাওয়ার পরেও একাত্ববাদী আল্লাহ এবং তাঁর একাত্ববাদী দ্বীনকে নিয়ে মতবিরোধ করে থাকে।
(ঘ) যারা আল্লাহর একাত্ববাদকে অস্বীকার করবে আল্লাহ তায়ালা তাদের থেকে হিসাব গ্রহণ করবেন। আর আল্লাহ তায়ালা যাদের থেকে হিসাব গ্রহণ করবেন, তাদের জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব হবে।
এত সুন্দর যৌক্তিক দলিল পাওয়ার পরেও যদি ইহুদী-খৃষ্টানরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে মতবিরোধে লিপ্ত হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহকে (সা.) তাদের মতবিরোধের উত্তরে নিম্নের তিনটি কাজ করতে বলেছেন:
(ক) তিনি যেন তাদের কাছে তার ও তার অনুসারীগণের ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন।
(খ) তাদেরকে যেন ইসলাম গ্রহণের প্রতি আহবান করেন।
(গ) রাসূলুল্লাহকে (সা.) তাদের উপর বল প্রয়োগ না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উপর দায়িত্ব হলো শুধু ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া, তারা চাইলে ইসলাম গ্রহণ করবে, আর না চাইলে গ্রহণ করবে না, এটা একান্তই তাদের ব্যাপার। ইসলাম গ্রহণ করলে হিদায়াত প্রাপ্ত হবে, আর না করলে পথভ্রষ্ট হবে।
(ঘ) তাদের সাথে বাড়াবাড়ি না করে, বরং তাদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন; কারণ আল্লাহ তায়ালা তাদের কর্মকান্ড স্বচক্ষে দেখছেন। (আইসার আল-তাফসীর: ১/২৯৬-২৯৭, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫২, আল-মোন্তাখাব: ১/৮৬) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿شَهِدَ﴾ “সাক্ষ্য দিয়েছেন”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: সংবাদ দিয়েছেন। আরবী ভাষায় ‘শাহাদাহ’ শব্দটি ‘সংবাদ দেওয়া’ অর্থে ব্যবহার হলে তার মধ্যে সরাসরি দেখে অথবা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জেনে সংবাদ দেওয়ার অর্থ নিহিত থাকে, যা দলীল হিসেবে গণ্য হয়। সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে: “আল্লাহ তায়ালা নিজে তাঁর একাত্ববাদের সংবাদ দিয়েছেন, ফেরেশতাগণ এ সংবাদ রাসূলদেরকে (আ.) দিয়েছেন, রাসূলগণ (আ.) এ সংবাদ ওলামায়ে কেরামকে দিয়েছেন এবং ওলামায়ে কেরাম এ সংবাদকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন”। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৭/১৬৮, তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১১৭)।

﴿أُولُو الْعِلْمِ﴾ “বিশেষজ্ঞগণ”, প্রায় সকল তাফসীর গ্রন্থে অত্র আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে: ‘বিশেষজ্ঞগণ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: নবী-রাসূলগণ এবং অহীর জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম। (তাফসীর আল-নাসাফী: ১/২৪২, তাফসীর গরীব আল-কোরআন: ৩/১৮) ।

﴿الْقِسْطِ﴾ “ন্যায়পরায়ণতা”, কথা, কাজ ও রায় প্রদানে ন্যায়পরায়ণতাকে বুঝানো হয়েছে (তাফসীর গরীব আল-কোরআন: ৩/১৮)। আয়াতে ‘ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত’ দ্বারা কার অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে? এ বিষয়ে কয়েকটি মত পাওয়া যায়:
(ক) অধিকাংশ তাফসীরকারকদের মতে, এখানে আল্লাহর অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে।
(খ) কোন কোন তাফসীরকারকগণের মতে, আয়াতে ‘উলুল ইলম’ বা আলেমদের অবস্থা বুঝানো হয়েছে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৭/১৭০) ।

﴿أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ﴾ “আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি”, আয়াতাংশে প্রথম শব্দ ‘আসলামতু’ দ্বারা ‘আমি একনিষ্ঠভাবে সোপর্দ করেছি’ বুঝানো হয়েছে। আর দ্বিতীয় শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: সকল অঙ্গপ্রতঙ্গের কর্ম। এখানে অংশ উল্লেখ করে পুরোটাকে বুঝানো হয়েছে। আয়াতের অর্থ হবে: আমার সকল কৃতকর্ম একমাত্র আল্লাহর জন্য সোপর্দ করেছি। (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/২৯৭, তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/২০) । একই অর্থে সূরা আনয়াম এর ১৬২ নাম্বার আয়াত এসেছে।

﴿الْأُمِّيِّينَ﴾ “নিরক্ষর”, এর দ্বারা আরবের মুশরিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। কারণ মুশরিকদের স্বভাব হলো লেখা-পড়া না করা। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/২০) । তবে আয়াতের শিক্ষা ব্যাপক হওয়ার কারণে এর দ্বারা সকল মুশরিকদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

উল্লেখিত আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
সূরার প্রথমাংশে আল্লাহর একাত্ববাদের আলোচনা ও তার স্বপক্ষে দলীল পেশ করা হয়েছে, (১০-১৩) নাম্বার আয়াতসমূহে একাত্ববাদকে অস্বীকারকারীর শাস্তির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং (১৫-১৭) নাম্বার আয়াতে যারা একাত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়ার পাশাপাশি তাক্বওয়ার গুণে গুনান্বিত হয় তাদের পুরস্কার বর্ণনা করা হয়েছে। আর অত্র আয়াত তথা (১৮-২০) নাম্বার আয়াতে সূরার প্রথমাংশে আল্লাহর একাত্ববাদের স্বপক্ষে উপস্থাপিত দলীলকে সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে সূদৃঢ় করা হয়েছে। সুতরাং পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে অত্র আয়াতাবলীর সম্পর্ক স্পষ্ট। (নাযম আল-দুরার, আল-বাক্বায়ী: ৪/২৮৭) ।

১৮ নাম্বার আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর শাম (সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন এবং ফিলিস্তিন) থেকে আহলে কিতাবের দুইজন পন্ডিত তার কাছে আগমন করেন। মদীনার শহর দেখে তাদের একজন আরেকজনকে বললেন: শেষ যমানায় একজন নবী যে শহরে আগমণ করবেন (যা আমরা আমাদের কিতাব থেকে জেনেছি), এ শহরটি সে শহরের মতো মনে হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে প্রবেশ করে তাকে দেখে তাদের কিতাবে বর্ণিত গুণের সাথে তার অবয়বের মিল দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: আপনি কি মোহাম্মাদ?
তিনি উত্তর দিলেন: হ্যা।
তারা আবার জিজ্ঞাসা করলেন: আপনি কি আহমাদ?
তিনি এবারও উত্তর দিলেন: হ্যা।
তারা বললেন: আমরা আপনাকে ‘শাহাদাহ’ বা সাক্ষ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবো, সঠিক উত্তর দিতে পারলে আমরা আপনার প্রতি ঈমান আনবো এবং আপনাকে সত্যায়ন করবো।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে বললেন: হ্যা, জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
তারা বললো: আল্লাহর কিতাবে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্যের বাণী কি? তাদের এ প্রশ্নের উত্তরে অত্র সূরার ১৮ নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করা হয়। (আসাবাব আল-নুযূল, ওয়াহেদী: ১/১০১) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। আঠার নাম্বার আয়াতে সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও ফেরেশতাদের সাথে আলেমদের নাম উল্লেখ করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্মানকে সমুন্নত করেছেন। ইমাম কুরতুবী (রা.) বলেন: আল্লাহ তায়ালা এবং ফেরেশতাদের নামের পাশে আলেমের নাম উল্লেখ করা তাদের মর্যাদার দলীল। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৪১) । সূরা ত্বহা এর ১১৪ নাম্বার আয়াতে রাসূলুল্লাহকে (সা.) ইলম বা জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলা হয়েছে এবং সূরা ফাতের এর ২৮ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহকে আলেমরা বেশী ভয় করেন। এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে আলেমের মর্যাদা বর্ণনাপূর্বক অনেকগুলো হাদীস এসেছে। এখন প্রশ্ন হলো আলেম এর সংজ্ঞা কি এবং আলেম দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে?
এটা একটি সমসাময়ীক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণ মুসলিমগণ আলেমদেরকে ধর্মীয় নেতা মানার কারণে কিছু ইসলাম বিদ্বেষী মুসলিম নামধারী নাস্তিক ‘আলেম’ শব্দটিকে সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এটা নিয়ে অযথা প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলতে চায় যারা জানে তারাই আলেম, হোক সে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত অথবা দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের এ কথা ভিত্তিহীন, মনগড়া এবং উদ্দেশ্য প্রনোদিত। এর স্বপক্ষে কোন দলীল নেই।
এখন মূল উত্তরে আসা যাক, রাসূলুল্লাহ (সা.) আলেমের কোন নির্দিষ্ট রুপরেখা দিয়ে না গেলেও সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের পরবর্তী সালফে সালেহীন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ‘আলেম’ শব্দটি দ্বারা কি বুঝানো হয়, তা উল্লেখ করার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: “যারা জানে ‘আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান’ তারাই আলেম”।
ইমাম ক্বাতাদাহ (র.) বলেন: আমাদের সময় বলা হতো: “অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকাটাই আলেম হওয়ার জন্য যথেষ্ট”। (তাফসীর আল-তাবারী: ২০/৪৬২) ।
রবী ইবনু আনাস (র.) বলেন: “যে আল্লাহকে ভয় করে না, সে আলেম না”।
সা’দ ইবনু ইব্রাহীম (র.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, মদীনাতে সবচেয়ে বড় আলেম কে? তিনি উত্তর দিলেন, “যিনি আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী ভয় করেন, তিনিই সবচেয়ে বড় আলেম”। (তাফসীরে কুরতুবী: ১৪/৩৪৩) ।
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (র.) সূরা ফাতের এর ২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আলেমের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন: “যিনি আল্লাহর একাত্ববাদ সম্পর্কে জানেন, তাকে ভয় করেন এবং তার থেকে আশা করেন, তিনিই আলেম”। (আল-তাফসীর আল-কাবীর: ২৬/২৩৬, ৭/১৬৯) ।
ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন: “যারা জেনে বুঝে আল্লাহর ক্ষমতাকে ভয় করে তারাই আলেম” (তাফসীরে কুরতুবী: ১৪/৩৪৩) ।
ইমাম নাসাফী (র.) বলেন: “যারা আল্লাহর গুণ জানে এবং তাঁর বড়ত্ব ঘোষণা করে, তারাই আলেম। আল্লাহর ব্যাপারে যে যত বেশী জানে, সে তাঁকে তত বেশী ভয় করে”। (তাফসীর আল-নাসাফী: ৩/৮৬) ।
সালফে সালেহীনের উল্লেখিত কথা থেকে স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহ সম্পর্কে যিনি জানেন এবং তাঁকে ভয় করেন, তিনিই আলেম। এ কথাকে আরেকটু সাজিয়ে লিখলে এভাবে লেখা যায়, “যিনি অহীর জ্ঞান জানেন, আল্লাহকে ভয় করেন এবং তদানুসারে আমল করেন, তিনিই আলেম”। (আল্লাহই ভালো জানেন) । সুতরাং আলেম হওয়ার জন্য তিনটি বিষয় খুবই জরুরী: (ক) অহীর জ্ঞান, (খ) আল্লাহর ভয় এবং (গ) জ্ঞান অনুসারে আমল।
যুগ যুগ ধরে আলেম শব্দের এ কনসেপ্ট সমাজে প্রচলিত। হঠাৎ করে কেউ এটাকে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে ভিন্ন খাতে চালানোর অপচেষ্টা চালালে তা গ্রহণযোগ্য নয়।

২। এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে, একাত্ববাদ আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত, এতদ্বসত্বেও তিনি নিজের ব্যাপারে কিভাবে সাক্ষী হন?
ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাযী (র.) এ প্রশ্নের উত্তরে তিনটি কথা বলেছেন:
(ক) প্রকৃত সাক্ষী আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নন। কারণ তিনি সর্বশক্তিমান, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করে সেগুলোকে তাঁর একাত্ববাদের প্রমাণ নির্ধারণ করেছেন। আর এ প্রমাণ যদি না থাকতো, তাহলে সাক্ষ্য দেওয়া শুদ্ধ হতো না। অতঃপর তিনি প্রমাণ সাব্যস্ত করে আলেমদেরকে তা জানার তাওফীক দিয়েছেন। আর যদি ঐ প্রমাণসমূহ তিনি আলেমদেরকে না জানাতেন, তাহলে তারা তাঁর একাত্ববাদকে জানতে অক্ষম হতো। ব্যাপারটা যখন এরকম, তখন একাত্ববাদের মূল সাক্ষী আল্লাহ নিজে হওয়াতে কোন দোষ নেই। এজন্যই সূরা আনয়াম এর উনিশ নাম্বার আয়াতে এসেছে:
﴿قُلْ أَيُّ شَيْءٍ أَكْبَرُ شَهادَةً قُلِ اللَّهُ شَهِيْدٌ بَيْنِيْ وَبَيْنَكُمْ﴾ [سورة الأنعام: ১৯].
অর্থাৎ: “বলো: সাক্ষী হিসেবে কার সাক্ষ্য সবচেয়ে বড়? আপনি জানিয়ে দিন, সাক্ষ্য একমাত্র আল্লাহ তায়ালার, যিনি আমার এবং তোমাদের মধ্যকার সর্বোত্তম সাক্ষী” (সূরা আনয়াম: ১৯)।
(খ) আল্লাহ তায়ালা চিরকাল এবং অনন্তকালের জন্য বিরাজমান। আর তিনি ছাড়া বাকী সবকিছু অতি ক্ষ‚দ্র একটি সময় অস্তিত্বে থাকার পর বাকী পুরো সময়ে অনুপস্থিত থাকে। আর অনুপস্থিত কারো সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং সাক্ষী হিসেবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই উপযুক্ত।
(গ) আয়াতে ‘সাক্ষ্য’ শব্দটি সংবাদ প্রদান করা অর্থে এসেছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তাঁর একাত্ববাদের সংবাদ দিয়েছেন। সুতরাং এখানে কোন প্রশ্ন থাকে না। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, আল-রাযী: ৭/১৬৯) ।

৩। উনিশ নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায়, ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। একাত্ববাদী আল্লাহকে মেনে নেওয়ার অর্থ হলো তাঁর একাত্ববাদী ধর্ম ইসলামকে মেনে নেওয়া। অন্য কোন ধর্ম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কোন গ্রহণ করতে চাইলে, তা তার পক্ষ থেকে গ্রহণ করাতো হবেই না, বরং সে ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন কোরআনে এসেছে:
﴿وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾ [سورة أل عمران: ৮৫] অর্থাৎ: “যারা ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আর সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে” (সূরা আলে-ইমরান: ৮৫) ।
আল্লাহ তায়ালার নিয়ম হলো যদি কেউ স্বেচ্ছায় বুঝেশুনে ইসলাম গ্রহণ করে থাকে, তাহলে এর জন্য সে আখেরাতে পুরস্কার পাবে। অন্যথায় আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন বিপদআপদ, ঝরতুফান এবং যেকোন আশংকাজনক পরিস্থিতিতে ফেলে এক মুহুর্তের জন্য হলেও তার থেকে ইসলাম এবং আল্লাহকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করে থাকেন। যেমন কোরআনে এসেছে:
﴿أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ﴾ [سورة آل عمران: ৮৩].
অর্থাৎ: “তারা কি আল্লাহর দ্বীন ছাড়া অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে? অথচ আসমান-যমীনের সবকিছুই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তার কাছে আত্মসমর্পণ করে, এবং তারা সকলে তাঁরই দিকে ফিরে যাচ্ছে” (সূরা আলে-ইমরান: ৮৩) ।

৪। বিশ নাম্বার আয়াতে, ইসলাম বিরোধীরা যদি ইসলামী দায়ীদের সাথে একাত্ববাদের বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হয় অথবা দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদের সাথে দায়ীরা কি আচরণ করবে তা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে:
প্রথমত: তারা একাত্ববাদের বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হলে দায়ী তার এবং তার অনুসারীদের অবস্থান দলীল সহ বিরোধীদের কাছে স্পষ্ট করবে।
দ্বিতীয়ত: তাদেরকে বিশুদ্ধ আক্বীদা-বিশ্বাসের দিকে আহবান করবে। এ সম্পর্কে সূরা আলে-ইমরানের আরেকটি আয়াতে এসেছে:
﴿قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ﴾ [سورة آل عمران: ৬৪].
অর্থাৎ: “হে আল্লাহর নবী! আপনি বলুন, হে আহলে কিতাব! এসো আমরা এমন এক কথার উপর একমত হই, যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে এক ও অভিন্ন; আমরা উভয় দল আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবো না, তার সাথে কাউকে শরীক করবো না এবং আল্লাহকে বাদ আমাদের মধ্য থেকে কাউকে প্রভ‚ বানাইবো না” (সূরা আলে-ইমরান: ৬৪) ।
তৃতীয়ত: তারা যদি দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে পর্যায়ক্রমে তিনটি কাজ করবে:
(ক) তাদেরকে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের স্বপক্ষে সাক্ষী রাখবে, এ সম্পর্কে আরেকটি আয়াতে এসেছে:
﴿فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ﴾ [سورة آل عمران: ৬৪].
অর্থাৎ: “অতঃপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বলুন: তোমরা সাক্ষী থেকো আমরা মুসলিম হয়েছি” (সূরা আলে-ইমরান: ৬৪) ।
(খ) নিজেদের দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্যে তাদেরকে ‘ইবতেহাল’ এর দিকে আহবান করবে। আর ‘ইবতেহাল’ হলো দুই দলই আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী দলের উপর গযব বর্ষণের দোয়া করবে। এ সম্পর্কে সূরা আলে-ইমরানের একষাট্টি নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে:
﴿فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ﴾ [سورة آل عمران: ৬১].
অর্থাৎ: “সত্যজ্ঞান তাদের কাছে পৌঁছার পরেও যদি তারা আপনার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়, তাহলে আপনি তাদেরকে বলে দিন: এসো আমরা আমাদের ও তোমাদের ছেলেদের, আমাদের নারীদের ও তোমাদের নারীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদেরকে ডেকে একত্রে জড়ো হয়ে দোয়া করবো; আমাদের মধ্যে যে দল মিথ্যাবাদী তার উপর যেন আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়” (সূরা আলে-ইমরান: ৬১া) ।
(গ) তাদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করবে, কারণ আল্লাহ তায়ালা তাদের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তাদেরকে যথসময়ে পাকড়াও করবেন। এ সম্পর্কে সূরা মুজ্জাম্মেল এর একটি আয়াতে এসেছে:
﴿وَذَرْنِي وَالْمُكَذِّبِينَ أُولِي النَّعْمَةِ وَمَهِّلْهُمْ قَلِيلًا – إِنَّ لَدَيْنَا أَنْكَالًا وَجَحِيمًا – وَطَعَامًا ذَا غُصَّةٍ وَعَذَابًا أَلِيمًا﴾ [سورة المزمل: ১১-১৩].
অর্থাৎ: “মিথ্যা সাব্যস্তকারী ও সম্পদের অধিকারীদের সাথে ফয়সালার ব্যাপারটা তুমি আমার কাছে ছেড়ে দাও এবং কিছুদিনের জন্য তাদেরকে অবকাশ দিয়ে রাখো। অবশ্যই আমার কাছে এদের পাকড়াও করার জন্য শেকল আছে এবং আছে শাস্তি দেওয়ার জন্য জাহান্নাম। আরো রয়েছে গলায় আটকে যাবে এমন খাবার এবং যন্ত্রণা দিবে এমন ধরণের আযাব” (সূরা মুজ্জম্মিল: ১১-১৩) ।

৫। বিশ নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় মুশরিকরা লেখাপড়া না করার কারণে শিরকে লিপ্ত হয়। মূলত মুশরিকদের একাত্ববাদের বিষয়ে লেখা-পড়া কম থাকার করণেই শিরকে জড়িয়ে পড়ে। এজন্য হিন্দু ধর্ম সহ অন্যান্য ধর্মে দেখা যায় অনুসারীদের জন্য ধর্মীয় শা¯্র পাঠ করা বৈধ নয়। ফলে, অজ্ঞতাবশত তারা এমন এমন শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়, যা সুস্থ কোন বিবেগ মেনে নিতে পারে না। এমনকি মুসলমানদের মধ্যে দেখা যায় যে দলগুলো শিরক-বিদয়াতে লিপ্ত, তারা নিজ দলের লেখা কিছু চটি বই ছাড়া বাহিরের কোন বই তাদের অনুসারীদেরকে পাঠ করতে অনুমতি দেয় না। অত্র আয়াতের মূল শিক্ষা হলো-কোরআন-হাদীসের বিভিন্ন ব্যাখ্যাগ্রন্থ সহ বিষয়ভিত্তিক সকল পড়তে হবে, যাতে আমাদেরকে মুর্খত স্পর্শ করতে না পারে; কারণ যখনই কাউকে মুর্খতা পেয়ে বসে, তখন সে যে কোন ধরণের শিরক-বিদয়াতে লিপ্ত হতে পারে। এজন্য ইসলাম সর্বদা পড়ার প্রতি উৎসাহিত করেছে। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

৬। আঠার নাম্বার আয়াতের ফযিলত সম্পর্কে জুবায়ের ইবনু আওয়াম থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন:
سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- وَهُوَ بِعَرَفَةَ يَقْرَأُ هَذِهِ الْآيَةَ ﴿شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُوا الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾ وَأَنَا عَلَى ذَلِكَ مِنْ الشَّاهِدِينَ يَا رَبِّ” (مسند أحمد: ১৪২১).
অর্থাৎ: “আরাফার ময়দানে রাসূলুল্লাহকে (সা.) আঠার নাম্বার আয়াতটি পড়ার পর “হে রব! আমিও এর উপর সাক্ষীদের অন্তর্ভূক্ত” পড়তে শুনেছি” (মুসনাদে আহমাদ: ১৪২১)।

আয়াতের আমল:
(ক) আলেমদের সাথে সদাচরণ করা।
(খ) ইসলামকে একমাত্র জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করা।
(গ) একজন ইসলামী দায়ীকে সংযত হয়ে বিরোধীদের সাথে নিম্নের আচরণ করা: (র) তাদের কাছে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করবে, (রর) তাদেরকে বিশুদ্ধ আক্বীদার দিকে আহবান করবে এবং (ররর) দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলে তাদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করবে।
(ঘ) হজ্জ পালনকারীদের জন্য আঠার নাম্বাত আয়াত আরাফার ময়দানে বেশী বেশী তেলাওয়াত করা।

 

সূরা আলে-ইমরান এর (১৫-১৭) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্য বিষয়: জান্নাত, যা দুনিয়া ও তার সৌন্দর্যের চেয়ে উত্তম।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ (15) الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ (16) الصَّابِرِينَ وَالصَّادِقِينَ وَالْقَانِتِينَ وَالْمُنْفِقِينَ وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ (17) [سورة آل عمران: 15-17]

আলোচ্য বিষয়: জান্নাত, যা দুনিয়া ও তার সৌন্দর্যের চেয়ে উত্তম।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
১৫। হে নবী! আপনি বলুন, আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দেব এর চেয়ে উত্তম বস্তুর? মোত্তাকীদের জন্য রয়েছে তাদের রবের কাছে এমন জান্নাত, যার নিচে প্রবাহমান আছে নদীসমূহ, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে, এবং পবিত্র স্ত্রীগণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে; আর আল্লাহ সম্যক দ্রষ্টা বান্দাদের সম্পর্কে।
১৬। যারা বলে, হে আমাদের রব! নিশ্চয় আমরা ঈমান এনেছি; অতএব আমাদেরকে ক্ষমা করুন আমাদের পাপসমূহ, এবং আমাদেরকে রক্ষা করুন জাহান্নামের আযাব থেকে।
১৭। যারা ধৈর্যশীল, যারা সত্যবাদী, যারা অনুগত, যারা দানশীল এবং রাতের শেষাংশে ক্ষমাপ্রার্থী।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে চৌদ্দ নাম্বার আয়াতে উল্লেখিত ছয়টি লোভনীয় বস্তুর চেয়ে উত্তম বস্তুর সংবাদ মানবজাতিকে প্রদানের জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেন: হে আল্লাহর নবী! আপনি তাদেরকে বলুন: আমি তোমাদেরকে লোভনীয় ছয়টি বস্তুর চেয়ে উত্তম কোন বস্তুর সংবাদ দিবো কি? তাহলে জেনে রাখো, যারা দুনিয়াতে তাক্বওয়া ভিত্তিক জীবনযাপন করে, তাদের জন্য আখেরাতে স্থায়ী ভোগবিলাসের জন্য তিনটি মহামূল্যবান বস্তু অবধারিত:
(ক) এমন আকর্ষণীয় মহামূল্যবান জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির নদীসমূহ প্রবাহমান রয়েছে।
(খ) হায়েজ-নেফাস থেকে পুতপবিত্র চিরকুমারী রমনী।
(গ) আল্লাহর সন্তুষ্টি।
সুতরাং সতর্ক হয়ে যাও, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।
নিম্ন বর্ণিত গুণে গুণান্বিত মোত্তাকিগণ উল্লেখিত পুরস্কার ভোগ করবে:
(ক) যারা অন্তর দিয়ে ঈমান গ্রহণ করে এবং মুখে জোড়ালোভাবে তার স্বীকৃতি প্রদান করে।
(খ) কৃতগুণাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়।
(গ) জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে।
(ঘ) বিপদেআপদে, সৎআমল করতে, হক্বের উপর অটুট থাকতে এবং দ্বীন প্রচারের কাজে ধৈর্যধারণ করে।
(ঙ) বিশ্বাস, কথা ও কাজে সত্যবাদী হয়।
(চ) বিনয়ের সাথে আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা.) অনুসরণ করে।
(ছ) সাধ্যমতো গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহর পথে দান করে।
(জ) শেষরাতে তাহাজ্জুদ সালাতে আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করে। (আইসার আল-তাফসীর: ১/২৯৫, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫১-৫২, আল-মোন্তাখাব: ১/৮৫-৮৬) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
(ذَلِكُمْ) “ঐগুলো”, ইঙ্গিতসূচক সর্বনাম। এর দ্বারা চৌদ্দ নাম্বার আয়াতে উল্লেখিত ছয়টি লোভনীয় বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
(أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ) “পুতপবিত্র স্ত্রী”, জান্নাতের হুর কে বুঝানো হয়েছে, যা হায়েজ-নেফাসের রক্ত সহ সকল ধরণের কদর্য ও অপরিচ্ছন্নতা থেকে পুতপবিত্র। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/১৫) ।
(الْأَسْحَارِ) “রাতের শেষাংশ”, সুবহে সাদিকের খুব কাছাকাছি সময়, রাতের একেবারে শেষাংশ, যে সময়ে রাতের আধার দিনের আলোর সাথে মিশে যায়। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/১৭১)।

আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতের সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াত তথা চৌদ্দ নাম্বার আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, “আল্লাহর কাছে উত্তম আশ্রয়স্থল বা ভোগসামগ্রী রয়েছে”। আর অত্র আয়াতসমূহ তথা (১৫-১৭) নাম্বার আয়াতে উক্ত আয়াতাংশের ব্যাখ্যা প্রদান করে বলা হয়েছে: আল্লাহর কাছে বিরাজমান উত্তম ভোগসামগ্রী হলো: জান্নাত, পুতপবিত্র রমনী এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি, যা আটটি গুণে গুণান্বিত মোত্তাক্বীদের জন্য অবধারিত। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/১৭১) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। পনের নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর লোভনীয় ছয়টি বস্তুর চেয়ে উত্তম এবং স্থায়ী তিনটি ভোগসামগ্রীর কথা বর্ণনা করেছেন। তিনটি বস্তুর সমন্বয়ে এমন একটি প্যাকেজ, যার মাধ্যমে একজন জান্নাতী আত্মিক এবং দৈহিক দুই ধরণের প্রশান্তি অনুভব করবেন। যেমন: তিনটি বস্তুর প্রথমটি হলো: জান্নাত, যা বিলাসবহুল থাকার জায়গা, দ্বিতীয় নাম্বার হলো: পুতপবিত্র রমনী, যা নয়নাভিরাম জান্নাতে ভোগবিলাসের জন্য রাখা হয়েছে। এ দুইটির মাধ্যমে একজন জান্নাতী সেখানে দৈহিক শান্তি অনুভব করবে। আর তৃতীয় নাম্বার হলো: আল্লাহর সন্তুষ্টি, এর মাধ্যমে একজন জান্নাতী আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করবে। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/১৭২) ।

২। পনের নাম্বার আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে: আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের অন্তর্নিহিত গোপন বিষয়, তাদের বাহ্যিক কৃতকর্ম এবং তাদের তাক্বওয়া সম্পর্কে স্ববিস্তারিক জ্ঞান রাখেন।
কোন কোন তাফসীরকারক অত্র আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেছেন: আল্লাহ তায়ালা তাদের তাক্বওয়া সম্পর্কে স্ববিস্তারিক জ্ঞান রাখেন। এ তথ্যের আলোকেই মহান ন্যায়পরায়ণ আল্লাহ তায়ালা হাশরের ময়দানে মানবজাতির বিচার করবেন। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/১৭৩)। কেউ তার কোন অপকর্মকে অস্বীকার করলে তার নিজস্ব অঙ্গ-প্রতঙ্গকে সাক্ষী হিসেবে দাড় করানো হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
﴿الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ﴾ [سورة يس: ৬৫].
অর্থাৎ: “আজ আমি তাদের মুখের উপর মোহর মেরে দিবো; তাদের হাতগুলো আমার সাথে কথা বলবে, তাদের পাগুলো তাদের কৃত অপকর্মের সাক্ষ্য দিবে” (সূরা ইয়াসিন: ৬৫) । সূরা নূর এর ২৪ নাম্বার আয়াতেও অনুরুপ বর্ণনা এসেছে।

৩। পনের নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় আল্লাহর কাছে বিরাজমান স্থায়ী ভোগসামগ্রী কেবল মোত্তাক্বীগণ ভোগ করতে পারবেন। এ জন্যই ইসলামের সকল আয়োজন, যেমন: সালাত, সওম, হজ্জ ইত্যাদি একজন মুমিনকে মোত্তাক্বী বানানোর জন্য।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাছে বিদ্যমান স্থায়ী ভোগসামগ্রী লাভের জন্য মুমিন অথবা মুসলিমকে বাদ দিয়ে মোত্তাক্বীকে খাস করলেন কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর হলো: একজন মুমিনের চারটি স্তর আছে:
(ক) ঈমান বা মুমিনের স্তর, যারা শুধু ঈমানের ৬টি রুকনকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে। এদের সংখ্যা খুব কম।
(খ) ইসলাম বা মুসলিমের স্তর, যারা ঈমানের ঘোষণা প্রদানের পাশাপাশি সালাত, সাওম, যাকাত এবং হজ্জ পালন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশী। এ দুই স্তরের মানুষ প্রথম ধাপে জান্নাত পাবে না, এ জন্য স্থায়ী ভোগসামগ্রী লাভের ক্ষেত্রে তাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
(গ) তাক্বওয়া বা মোত্তাক্বীর স্তর, যারা ঈমান এবং ইসলামের চর্চা করতে করতে এমন পর্যায় পৌঁছে গেছে যে অপরাধে জড়াতে চাইলেও আল্লাহর ভয়ের কারণে জড়াতে পারে না, অথবা ভুলক্রমে জড়িয়ে পড়লেও সাথে সাথে অনুশোচনা করে তাওবা-ইস্তেগফার করে। এদের সংখ্যা কম। এ স্তরের মানুষ হিসাবনিকাসের পর প্রথম ধাপেই জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(ঘ) ইহসান বা মুহসিনের স্তর, যারা ঈমান, ইসলাম ও তাক্বওয়ার চর্চা করতে করতে এমন পর্যায় পৌঁছে গেছে যে তারা কোন অপরাধে জড়ানোর কথা ভাবতেই পারে না। সাহাবীদের বিশাল অংশ এ স্তরের অন্তভর্ভূক্ত ছিলেন। বর্তমানে এদের সংখ্যা খুবই কম। এ স্তরের মানুষ সহজ হিসাবনিকাসের পর প্রথম ধাপেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, যা সূরা ইনশেক্বাক্ব এর আট নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে।
মুমিনের চারটি স্তর সম্পর্কে একটি আয়াতে এসেছে:
﴿لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا إِذَا مَا اتَّقَوْا وَآمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوْا وَآمَنُوا ثُمَّ اتَّقَوْا وَأَحْسَنُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾ [سورة المائدة: ৯৩].
অর্থাৎ: “যারা ঈমান এনেছে এবং নেকআমল করেছে, নিষেধাজ্ঞার পূর্বে তারা যা খেয়েছে তার জন্য তাদের গুনাহ হবে না। তবে শর্ত হলো: ভবিষ্যতে যদি তারা ঈমান, নেকআমল ও তাক্বওয়ার সাথে জীবনযাপন করে। অতঃপর তারা ঈমান আনে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে; অতঃপর তারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে এবং ইহসান করে। আর আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভালোবাসেন” (সূরা মায়িদাহ: ৯৩) ।
এ সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“إِنَّ اللَّهَ قَالَ مَنْ عَادَى لِى وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ ، وَمَا تَقَرَّبَ إِلَىَّ عَبْدِى بِشَىْءٍ أَحَبَّ إِلَىَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ ، وَمَا يَزَالُ عَبْدِى يَتَقَرَّبُ إِلَىَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ ، فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِى يَسْمَعُ بِهِ ، وَبَصَرَهُ الَّذِى يُبْصِرُ بِهِ ، وَيَدَهُ الَّتِى يَبْطُشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِى يَمْشِى بِهَا ، وَإِنْ سَأَلَنِى لأُعْطِيَنَّهُ ، وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِى لأُعِيذَنَّهُ ، وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَىْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِى عَنْ نَفْسِ الْمُؤْمِنِ ، يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ” (صحيح البخاري: ৬০৫২).
অর্থাৎ: “আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোন বন্ধুর সাথে দুশমনি করবে, আমি সার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব। আমি যা কিছু আমার বান্দার উপর ফরয করেছি, কেবল তা দ্বারা কেউ আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, তবে নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থণা করে, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি কোন কাজ করতে চাইলে তা করতে দ্বিধা করি না, যতটা দ্বিধা করি মুমিন বান্দার প্রাণ নিতে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করি” (সহীহ আল-বুখারী: ৬০৫২) ।
একজন মুমিন মোত্তাক্বী কিনা তা সে নিজেই পরীক্ষা করতে পারেন। পরীক্ষা করার সহজ উপায় হলো: যে কোন ধরণের খারাপ কাজে লিপ্ত হতে গেলেই আল্লাহর উপস্থিতির কথা স্মরণ করে তা থেকে বিরত থাকা। এ লক্ষণ যার ভিতর পরিলক্ষিত হবে সে আল্লাহর কাছে মোত্তাক্বী হিসেবে গণ্য হবে। এ অবস্থার উপর দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলে একপর্যায়ে সে মুহসিনের স্তরে উন্নিত হবে, ইনশাআল্লাহ।

৪। পনের নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় কে কতটুকু তাক্বওয়ার অধিকারী তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা জানেন। এজন্য মানুষ যাকে তার বাহ্যিক বেসবুসা দেখে মোত্তাক্বী বা বুযূর্গ ধারণা করে, আল্লাহর কাছে সে মোত্তাক্বী নাও হতে পারে। কোরআন-সুন্নাহের অনেক জায়গায় দেখতে পাই দুনিয়ায় মোত্তাক্বী হিসেবে খ্যাত কিছু মানুষকে জাহান্নামে দেখতে পেয়ে তার ভক্তবৃন্দ রীতিমতো হতভাগ হবে। সুতরাং আমাদের উচিৎ মানুষকে পরোয়া না করে আল্লাহর দফতরে মোত্তাক্বী হিসেবে নাম লেখানোর জন্য চেষ্টা করা। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

৫।ষোল এবং সতের নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যে সকল মোত্তাক্বীগণ আখেরাতের স্থায়ী ভোগসামগ্রী লাভে ধন্য হবেন তাদের আটটি গুণ বর্ণনা করেছেন:
(ক) যারা অন্তর দিয়ে ঈমান গ্রহণ করে এবং মুখে জোড়ালোভাবে তার স্বীকৃতি প্রদান করে।
(খ) কৃতগুণাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়।
(গ) জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে।
(ঘ) বিপদেআপদে, সৎআমল করতে, হক্বের উপর অটুট থাকতে এবং দ্বীন প্রচারের কাজে ধৈর্যধারণ করে।
(ঙ) বিশ্বাস, কথা ও কাজে সত্যবাদী হয়।
(চ) বিনয়ের সাথে আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা.) অনুসরণ করে।
(ছ) সাধ্যমতো গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহর পথে দান করে।
(জ) শেষরাতে তাহাজ্জুদ সালাতে আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করে।

আয়াতের আমল:
আখেরাতে মুক্তি এবং স্থায়ী ও উত্তম ভোগসামগ্রী লাভের জন্য আয়াতে বর্ণিত একজন মোত্তাক্বীর আটটি গুণ দিয়ে দৈনন্দিন জীবনকে সাজানো।

সূরা আলে-ইমরানের চৌদ্দ নাম্বার আয়াতের তাফসীর, আলোচ্য বিষয়: পৃথিবীর লোভনীয় বস্তুর প্রতি মানুষের স্বভাবজাত ভালোবাসা একটি পরীক্ষা।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآبِ (১৪) [سورة آل عمران: ১৪].

আয়াতের আলোচ্যবিষয়:
পৃথিবীর লোভনীয় বস্তুর প্রতি মানুষের স্বভাবজাত ভালোবাসা একটি পরীক্ষা।

আয়াতের সরল অনুবাদ ও শব্দার্থ:
সুশোভিত করা হয়েছে মানুষের নিকট লোভনীয় বস্তুসমূহের প্রতি ভালোবাসাকে: নারী, সন্তানসন্ততি, রাশি রাশি সোনা-রুপা, চিহ্ণিত ঘোড়া, চতুষ্পদ জন্তু এবং শস্যক্ষেত; এগুলো ভোগসামগ্রী পার্থিব জীবনের; আল্লাহ তায়ালার নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।

আয়াতের ভাবার্থ:
নিশ্চয় মানবজাতিকে পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টিগতভাবে ৬টি লোভনীয় বস্তুর প্রতি আসক্ত করে সৃষ্টি করা হয়েছে: (ক) নারী, (খ) সন্তানসন্ততি, (গ) রাশি রাশি সোনা-রূপা, (ঘ) পছন্দসই চিহ্ণিত ঘোড়া, (ঙ) গবাদি পশু, যেমন: উট, গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি এবং (চ) শস্যক্ষেত। এ লোভনীয় বস্তুগুলো আখেরাতে কারো কোন উপকার করতে পারবে না, যদি তার মধ্যে ঈমান, সৎআমল, শীরক-কুফরীর প্রতি ঘৃণা এবং উল্লেখিত বস্তুগুলোকে ব্যবহার করার ইলাহী বিধান জানা না থাকে। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে বলেছেন: কিন্তু এগুলো ক্ষণিকের এ দুনিয়ার ভোগ্যসামগ্রী মাত্র, যা মৃত্যুর সাথে সাথে ভোগকারীর জীবন থেকে নিঃশেষ হয়ে যাবে, আর আল্লাহর নিকট রয়েছে স্থায়ী জান্নাতের উত্তম ভোগসমগ্রী। (তাফসীর আল-কাশশাফ: ১/৩৪২, আল-মুন্তাখাব: ১/৮৫, আল-মুয়াসসার: ১/৫১, আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/২৯২) ।

আয়াতের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
(الشَّهَوَاتِ) ‘লোভ-লালসা’, সকল তাফসীরের ভাষ্যমতে অত্র আয়াতে ‘লোভ-লালসা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ‘লোভনীয় বস্তুসমূহ’। এখানে শব্দমূল ব্যবহার করে ঐ শব্দের অর্থটি যে সকল বস্তুর সাথে প্রযোজ্য হয় তা উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এ রকম ব্যবহার আরবী ভাষায় সচরাচর পাওয়া যায়। যেমন: ‘পান করা’ শব্দ ব্যবহার করে পানোপযুক্ত সকল বস্তুকে বুঝানো হয়।
ইমাম জমাখশারী (র.) আরবী ভাষায় এ রকম ব্যবহারের উপকারিতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: এতে অর্থের আধিক্যতার প্রতি ইঙ্গিত আছে। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, শাহওয়াত বা লোভ-লালসা বেশী থাকা পশুর গুণ। মানুষ যখন আয়াতে উল্লেখিত ছয়টি বস্তুর প্রতি বেশী আসক্ত হয়, তখন সে পশুর পর্যায় নেমে যায়। সুতরাং আয়াতে এ শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন। (তাফসীর আল-কাশশাফ: ১/৩৪২) ।
(الْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ) ‘আল-ক্বানাতীরুল মুক্বানতারা’, ‘আল-ক্বানাতীর’ আরবী ভাষার বহুবচনের শব্দ, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: রাশি রাশি সম্পদ। এর এক বচনের শব্দ হলো: ‘ক্বিনতার’। এর পরিমাণ নিয়ে অনেক মতামত পাওয়া যায়। ইমাম জাযায়িরী (র.) তার তাফসীর গ্রন্থে একটি মত দিয়েছেন, তা হলো: এক ক্বিনতার হলো: ১১০০ আওক্বিয়া রুপা। আর ‘আল-মুক্বানতারা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অঢেল বা রাশি রাশি। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৯২) ।
বর্তমান প্রচলিত পরিমাপে এর ওজন দাড়ায় প্রায় ১৩১ কেজি রুপা। যার বর্তমান বাজার মূল্য ১০ কোটি ৬১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। আর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ‘ক্বিনতার’ এর বহুবচনের রুপ ব্যবহার করে রাশি রাশি সম্পদের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। (আল্লাহ ভালো জানেন)
(مَتَاعُ) ‘ভোগ্যসামগ্রী’, দুনিয়ার উপভোগ্য বস্তুর ক্ষেত্রে আরবী ভাষায় এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়; কারণ এর অর্থের মধ্যে হারিয়ে ফেলা বা আলাদা হওয়ার একটি অর্থ রয়েছে, অর্থাৎ দুনিয়ার ভোগ্য সামগ্রীকে ভোগকারী যে কোন মুহুর্তে হারিয়ে ফেলতে পারে। হয়তো ভোগসামগ্রী ভোগকারী থেকে আলাদা হওয়ার মাধ্যমে, নয়তো ভোগকারী তার ভোগসামগ্রী থেকে আলাদা হওয়ার মাধ্যমে পৃথক হয়ে যাবে। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/১৪) ।

আয়াতের সাথে পূর্বের আয়াতের সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলী তথা (১০-১৩) নাম্বার আয়াতে দুনিয়ার ধনসম্পদ, সন্তানসন্তুত এবং ভোগসামগ্রীর মোহে পড়ে আখেরাত থেকে বিমুখ হওয়ার পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আর অত্র আয়াতে দুনিয়ার ছয়টি অতি লোভনীয় বস্তুর উল্লেখপূর্বক মানবজাতিকে সতর্ক করা হয়েছে যে অতি মোহের কারণে উল্লেখিত বস্তুর ভালোবাসার জালে যেন কেউ আটকিয়ে না যায় এবং স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে দুনিয়ার ভোগবিলাসিতার চেয়ে আখেরাতের সফলতাই একজন মানুষের মুখ্য বিষয় হওয়া উচিৎ। সুতরাং পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে অত্র আয়াতের সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১০৮) ।
পূর্বের আয়াতাবলীতে দুনিয়ার মোহে আসক্ত হওয়ার পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, আর অত্র আয়াতে দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হওয়ার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাব জুহাইলী: ৩/১৬৪) ।

আয়াত সংশ্লিষ্ট ঘটনা:
ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাজী (র.) অত্র আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট দুইটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন:
(ক) আবু হারেসা ইবনু আলক্বামাহ নামক খৃষ্টান তার ভাইয়ের ইসলাম গ্রহণের সংবাদ পেয়ে রোম স¤্রাট তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা ও সহায়সম্পত্তি ছিনিয়ে নেয়ার ভয়ে তাকে ইসলাম থেকে ফিরে আসতে বাধ্য করে। এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে সহ বিশ্বমানবতাকে সতর্ক করেছেন।
(খ) বদরের যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনার ইহুদিদেরকে সতর্ক করে দিলে তারা তাদের ধনসম্পদ, জনশক্তি এবং ক্ষমতার দাম্ভিকতা করে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলমানদেরকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল। অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে সহ সকল মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৭/১৫৯) ।

আয়াতের শিক্ষা:
১। এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে, মানুষের ভালোবাসাকে সরাসরি ছয় বস্তুর দিকে সম্বন্ধ করে “মানুষকে সৃষ্টিগতভাবে নারী, সন্তানসন্তুত, রাশি রাশি সম্পদ, ইত্যাদির ভালোবাসায় সজ্জিত করা হয়েছে” না বলে ‘ভালোবাসা’ ও ছয়টি বস্তুর মধ্যে একটি ‘শাহওয়াত’ বা কামনাবাসনা শব্দটিকে যোগ করে “মানুষকে সৃষ্টিগতভাবে নারী, সন্তানসন্তুত, রাশি রাশি সম্পদ ইত্যাদির প্রতি কামনাবাসনার ভালোবাসায় সজ্জিত করা হয়েছে” বলার কারণ কি?
এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, উল্লেখিত ছয়টি বস্তুকে ভালোবাসা দোষের নয়, বরং প্রশংসনীয়। অপরদিকে এগুলোর প্রতি অতিমাত্রায় আশক্ত হওয়া দোষের। এজন্য আল্লাহ তায়ালা প্রথম পদ্ধতি অবলম্বন না করে দ্বিতীয় পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে মানবজাতিকে ছয়টি বস্তুর প্রতি এ ধরণের অতিমাত্রায় আসক্ত হওয়া থেকে সতর্ক করেছেন। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/১৪) ।

২। মানবজাতিকে ছয়টি লোভনীয় বস্তুর প্রতি আসক্ত করে সজ্জিত করা হয়েছে, এখন প্রশ্ন হলো: কে সজ্জিত করেছেন, আল্লাহ নাকি শয়তান?
এ আয়াতাংশের সাথে আক্বীদার বিষয় সম্পৃক্ত। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত মনে করেন, প্রথিবীর ভালোমন্দ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, এমনকি মানুষের ভালোমন্দ সকল কর্মেরও সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা।
অপরদিকে মোতাজিলা সম্প্রদায় মনে করেন, ভালো জিনিস ও কর্মের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, আর মন্দ জিনিষ ও কর্মের সৃষ্টিকর্তা শয়তান। তারা আরো বলেন, মানুষ তার কর্মের সৃষ্টিকর্তা।
এখন প্রশ্নের উত্তরে ফিরে যাওয়া যাক, প্রায় সকল তাফসীর গ্রন্থে বলা হয়েছে, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে, আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষার জন্য সৃষ্টিগতভাবে মানবজাতিকে ছয়টি লোভনীয় বস্তুর প্রতি আসক্ত করে তৈরি করেছেন। যেমন: অন্য একটি আয়াতে এসেছে:
(إِنَّا جَعَلْنا ما عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَها لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا) [سورة الكهف: ৭].
অর্থাৎ: “যা কিছু যমীনের বুকে আছে আমি তাকে অবশ্যই তার জন্যে শোভা বর্ধনকারী বানিয়েছি, যাতে তাদের আমি পরীক্ষা করতে পারি যে, তাদের কাজকর্মের দিক থেকে কে বেশী উত্তম” (সূরা কাহ্ফ: ৭) । অন্য আরেকটি আয়াতে এসেছে:
(كَذلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ) [سورة الأنعام: ১০৮].
অর্থাৎ: “এভাবে আমি প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের নিজেদের কার্যকলাপ সুশোভন করে রেখেছি” (সূরা আনয়াম: ১০৮) ।
আর শয়তান মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করার জন্য উল্লেখিত ছয়টি বস্তুকে মানুষের সামনে সজ্জিত করে উপস্থাপন করে। যেমন: কোরআনের একটি আয়াতে এসেছে:
(وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ) [سورة الأنفال: ৪৮].
অর্থাৎ: “যখন শয়তান তাদের কাজগুলো তাদের সামনে খুব চাকচিক্যময় করে পেশ করেছিলো” (সূরা আনফাল: ৪৮) ।

৩। আয়াতের মৌলিক শিক্ষা হলো: কোন বস্তুকে ভালোবাসার দুইটি স্তর:
(ক) অপছন্দ করা সত্তেও কোন বস্তুকে ভালোবাসা। যেমন: একজন মুসলিম তার স্বভাবজাত কারণে কিছু হারাম বস্তুকে ভালোবাসে, কিন্তু সে খারাপ বস্তুটিকে ভালোবাসতে অপছন্দ করে। এ ধরণের ভালোবাসার জন্য কাউকে পাকড়াও করা হবে না।
(খ) কোন বস্তুকে পছন্দ করতে ভালোবাসা, যার ভিতর তিনটি স্তর একত্রে নিহীত থাকে: (ক) বস্তুকে ভালোবাসা, (খ) ঐ বস্তুর প্রতি কামনাবাসনাকে ভালোবাসা এবং (গ) এ ভালোবাসাকে কল্যানকর মনে করা। এটা ভালোবাসার চুড়ান্ত স্তর। এর দুইটি রুপ হতে পারে:
(র) বস্তুটির প্রতি কামনাবাসনার ভালোবাসা থাকাটা কল্যানকর, যেমন: সূরা স্বাদ এর ৩২ নাম্বার আয়াতে সোলাইমান (আ.) বলেছিলেন: আমি কল্যানকর বস্তুকে ভালোবাসতে পছন্দ করি। অর্থাৎ- আমি কল্যানকর বস্তুকে ভালো বাসি এবং সেটাকে ভালোবাসতে পছন্দ করি। এ ধরণের ভালোবাসা প্রশংসনীয়।
(রর) বস্তুটির প্রতি কামনাবাসনার ভালোবাসা থাকা অকল্যানকর, যেমন: সূরা আলে ইমরানের ১৪ নাম্বার আয়াতে যে ছয়টি বস্তুর কথা বলা হয়েছে। মানুষ যখন এ জাতিয় বস্তুর প্রতি এ পর্যায়ের ভালোবাসায় উপনিত হয়, তখন সে আল্লাহর একান্ত দয়া ছাড়া সেখান থেকে ফিরে আসতে পারে না। এ ধরণের ভালোবাসা নিন্দনীয়। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৭/১৬১) ।

৪। এখন একটি প্রশ্ন হতে পারে, আয়াতে বর্ণিত ছয়টি লোভনীয় বস্তুর প্রতি ভালোবাসা কখন বৈধ হয় এবং কখন অবৈধ হয়?
এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর হলো- যখন উল্লেখিত বস্তুকে অর্জন করার পিছনে নি¤েœর উদ্দেশ্যগুলো পাওয়া যাবে, তখন তার প্রতি ভালোবাসা বৈধ হবে:
(ক) দ্বীনের কাজে ব্যবহার করা।
(খ) এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
(গ) অর্জিত হওয়ার পর তা শরিয়তের বিধান অনুযায়ী ব্যবহার করা।
এবং যখন উল্লেখিত বস্তুকে অর্জন করার পিছনে নি¤েœর উদ্দেশ্যগুলো পাওয়া যাবে, তখন তার প্রতি ভালোবাসা অবৈধ হবে:
(ক) দ্বীনের ক্ষতি সাধনের কাজে ব্যবহার করা।
(খ) এর মাধ্যমে দাম্ভিকতা পোষণ করা।
(গ) অর্জিত হওয়ার পর বেপড়োয়া হয়ে যাওয়া। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।
উল্লেখিত প্রশ্নের বর্ণনামূলক উত্তর হলো:
নারী: প্রাপ্ত বয়স্কে উপণিত হওয়ার পর প্রত্যেক পুরুষের সব থেকে বেশী প্রয়োজন বোধ হয় একজন সঙ্গিনীর। নারীর প্রতি পুরুষের ভালোবাসা ইসলামী শরিয়তের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে তা বৈধ বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু শরয়ী বিধানকে পড়োয়া না করে তাদেরকে কেবল কামনাবাসনা, ভোগবিলাসিতা, যৌন চাহিদা, বেহায়াপনা ইত্যাদির জন্য ভালোবাসা হলে তা অবৈধ হবে।
সন্তানসন্ততি: মুসলিম জনশক্তি বৃদ্ধি, প্রজনন ধারা অব্যাহত রাখা, দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করা, আল্লাহর পথের সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলা, জনসেবায় পেশ করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে তাদেরকে ভালোবাসা প্রশংসনীয়। কিন্তু পৃথিবীতে ক্ষমতা বাড়ানোর নেশা, ইসলাম বিরোধী জনশক্তি বৃদ্ধি, দাম্ভিকতা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে তাদেরকে ভালোবাসা নিন্দনীয়।
ধনসম্পদ: জীবন ধারণ করা, আত্মীয়দের সহযোগিতা করা, দানসদকা করা, দ্বীনের পথে ব্যয় করা, অন্যের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ধনসম্পদকে ভালোবাসা প্রশংসনীয়। কিন্তু দাম্ভিকতা, ইসলাম বিরোধী শক্তিকে শক্তিশালী করা, কেবল দুনিয়া নিয়ে মত্ত থাকা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ধনসম্পদকে ভালোবাসা অবৈধ।
ঘোড়া: আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং জিহাদের প্রস্তুতির জন্য ঘোড়াকে ভালোবাসা প্রশংসনীয়, কিন্তু দাম্ভিকতার জন্য ভালোবাসা নিন্দনীয়।
চতুষ্পদ জন্তু: চাষাবাদ করা, বোঝা বহণের কাজ নেওয়া, জমি থেকে ফসলাদি উৎপন্ন করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে চতুষ্পদ জন্তুকে ভালোবাসা প্রশংসনীয়। কিন্তু কেবল দুনিয়া অর্জন, দাম্ভিকতা, আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন হয়ে সুখ-স¦াচ্ছন্দ্যের জীবন নিয়ে মেতে থাকা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে চতুষ্পদ জন্তুকে ভালোবাসা নিন্দনীয়।
শস্যক্ষেত: অন্যকে উপকার করার জন্য চাষাবাদ করার উদ্দেশ্যে শস্যক্ষেতকে ভালোবাসা প্রশংসনীয়। কিন্তু কেবল দুনিয়া অর্জন, দাম্ভিকতা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে শস্যক্ষেতকে ভালোবাসা নিন্দনীয়। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/১৬৬-১৬৮) ।
উল্লেখিত আয়াতে, মূলত ছয়টি লোভনীয় বস্তুর কামনাবাসনায় মত্ত হয়ে মানুষ যেন আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে গিয়ে কেবল দুনিয়া অর্জন, দাম্ভিকতা, ভোগবিলাসিতা ইত্যাদিতে জড়িয়ে না পড়ে, তা থেকে সতর্ক করা হয়েছে।

আয়াতের আমল:
ছয়টি লোভনীয় বস্তু: নারী, সন্তানসন্ততি, ধনসম্পদ, ঘোড়া, চতুষ্পদ জন্তু এবং শস্যক্ষেতকে কামনাবাসনার সাথে ভালোবাসা যাবে না। বরং কেবল দুনিয়া অর্জন এবং দাম্ভিকতাকে বাদ দিয়ে কেবল জীবন জীবিকার তাকিদে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এগুলোকে ভালোবাসা।

error: Content is protected !!