Skip to main content

সূরা আলে-ইমরানের ৯২নং আয়াতের তাফসীর, আয়াতের আলোচ্যবিষয়: পূণ্যময় দানের ধরণ এবং তার প্রতিফল

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (92)﴾ [سورة آل عمران: 86-91]

 

আয়াতের আলোচ্যবিষয়: পূণ্যময় দানের ধরণ এবং তার প্রতিফল

আয়াতের সরল অনুবাদ:
৯২। তোমরা কখনও সওয়াব অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় বস্তু ব্যয় করবে। আর যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয় সম্যক জ্ঞাত।

আয়াতের ভাবার্থ:
আল্লাহ তায়ালা তাঁর মুমিন বান্দাদের, যারা তাঁর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা কখনই জান্নাত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবে না যতক্ষণ না তারা তাদের প্রিয় ও উৎকৃষ্ট সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে।
অতঃপর তিনি তাদেরকে আশ্বস্ত করেন যে, তারা যতটুকু খরচ করে, তা অল্প হোক বা বেশী, মূল্যবান হোক বা সাধারণ, তিনি সবকিছুরই জ্ঞান রাখেন এবং সে অনুযায়ী প্রতিফল দিবেন। এর মাধ্যমে তিনি তাদের মধ্যে দান করার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করেন এবং উৎসাহ দেন।
এ আয়াত অবতীর্ণ হলে, আবু তালহা (রা.) এসে বললেন: হে আল্লাহর নবী! আমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ হলো- ‘বাইরুহা’ নামের একটি বাগান। আমি এটিকে আল্লাহর পথে দান করতে চাই। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: এটি লাভজনক সম্পদ, তুমি এটি তোমার আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিতরণ করো। অতঃপর তিনি সেটি আত্মীয়দের (হাসান বিন সাবিত ও উবাই ইবনু কা’ব) মাঝে বিতরণ করে দিলেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৯৪, আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৪৫-৩৪৬, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৬২, আল-মোন্তাখাব: ১/১০০) ।

আয়াতের বিরল শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿الْبِرَّ﴾ ‘পুণ্য বা সওয়াব’, এখানে আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- জান্নাত। অর্থাৎ: তোমাদের প্রিয় বস্তু ব্যয় না করা পর্যন্ত জান্নাত লাভ করতে পারবে না। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়েরী: ১/৩২৫) ।

﴿تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ﴾ ‘তা থেকে ব্যয় করো, যা তোমরা ভালোবাসো’, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- মানের দিক থেকে উৎকৃষ্ট এবং তোমাদের কাছে প্রিয়, তা আল্লাহর পথে ব্যয় করো। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৯২) ।

﴿حَتَّى تُنْفِقُوا﴾ ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্যয় করবে’, আয়াতাংশে ব্যয় করা দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে? এ সম্পর্কে তাফসীরকারকদের থেকে কয়েকটি মত পাওয়া যায়:
(ক) হাসান বসরী (র.) এর মতে, এখানে ‘যাকাত’কে বুঝানো হয়েছে।
(খ) ইমাম যমাখশারী (র.) বলেন: এই আয়াতে আল্লাহর রাস্তায় দানের ক্ষেত্রে শুধু যাকাত নয়, বরং সমস্ত প্রকার সদকা ও স্বেচ্ছা দানকেও অন্তরর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে শর্ত রাখা হয়েছে যে, দান অবশ্যই এমন সম্পদ থেকে হতে হবে যা দানকারীর কাছে প্রিয়, মূল্যবান এবং মন থেকে দিতে কষ্ট হয়। কারণ, সত্যিকারের ত্যাগ ও খোদাভীতি তখনই প্রকাশ পায় যখন মানুষ নিজের প্রিয় বস্তু হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করে। অর্থাৎ, এই আয়াতের মূল শিক্ষা হলো দান এমন হওয়া উচিত যা অন্তর থেকে আসে এবং যার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, লোক দেখানো বা অবহেলিত সম্পদ থেকে নয়। (তাফসীর আল-কাশশাফ: ১/৩৮৪) ।
দ্বিতীয় মতটি গ্রহণ করা হলে, দুইটি মতের উপরই আমল হয়ে যায়। সুতরাং আয়াতে ব্যয় দ্বারা যাকাত ও সাধারণ দান-সদাকা এবং হাদিয়া-তোহফা সবকিছুকেই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ: মানুষের সকল প্রকার দানই উৎকৃষ্ট সম্পদ থেকে হওয়া উচিৎ। (আল্লাহই ভালো জানেন)।

উল্লেখিত আয়াতের সাথে অন্যান্য আয়াতের সম্পর্ক:
অত্র সূরার বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইহুদী-খৃষ্টানদের বিভিন্ন দাবি, যেমন: তাদের নিজেদেরকে একমাত্র ঈমানদার ধারনা করা, নবুওয়াত শুধু তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা, তারা আল্লাহর একমাত্র মনোনিত জাতি, তারা জাহান্নামে অল্প কিছু দিন ছাড়া অবস্থান করবে না ইত্যাদির কথা তুলে ধরেছেন। অত্র আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সত্যিকার ঈমানের মানদন্ড জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: ঈমানের সত্যিকার মাপকাঠি হলো: “আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয় জিনিসগুলো দান করা” তা যেন হয় নিঃস্বার্থভাবে ও উত্তম অভিপ্রায়ে। অথচ, হে দাবীদারগণ! তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে অর্থ-সম্পদের প্রতি লালসা পোষণ করো। যদি তোমাদের কেউ কিছু দান করে, তাহলে তা এমন জিনিস হয়, যা তোমার কাছে তুচ্ছ, যা তুমি অপছন্দ করো। কারণ, তোমাদের অন্তরে অর্থের প্রতি ভালোবাসা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার চেয়ে বেশি, আর সম্পদ জমা করে রাখার আকাংক্ষা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রতিদানের চেয়ে বড় হয়ে গেছে। তাহলে কীভাবে তোমরা আশা করো যে তোমরা হবে সত্যিকার মুমিন, যখন তোমরা আল্লাহর রাস্তায় প্রিয় জিনিসগুলোই দান করতে পারো না? (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/২১১) ।

আয়াত সংশ্লিষ্ট কিছু ঘটনা:
প্রথম ঘটনা:
সহীহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে: উল্লেখিত আয়াতটি অবতীর্ণ হলে উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) বলেছিলেন: “হে আল্লাহর রাসূল! খাইবারে আমার যে জমির অংশ রয়েছে, তার চেয়ে আমার কাছে কোনো সম্পদ বেশি প্রিয় নয়। আপনি বলুন, আমি তা কীভাবে ব্যয় করব?” রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: “মূল সম্পদটিকে স্থায়ী করে দাও অর্থাৎ বিক্রি করো না, আর এর থেকে উৎপন্ন ফসল বা লাভ জনসাধারণের কল্যাণে সদকা করো”। (তাফসীর ইবনু কাসীর: ২/৭৩) ।
দ্বিতীয় ঘটনা:
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেন: আবু তালহা (রাঃ) ছিলেন মদিনার আনসারদের মধ্যে সবচেয়ে ধনবান ব্যক্তি। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ ছিল ‘বাইরুহা’ নামক একটি বাগান। এই বাগানটি ছিল মসজিদে নববীর সামনের দিকে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই সেখানে যেতেন ও তার বিশুদ্ধ পানি থেকে পান করতেন।
আনাস (রাঃ) বলেন: যখন কুরআনের উল্লেখিত আয়াত অবতীর্ণ হলো, তখন আবু তালহা (রাঃ) বললেন: “হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা কখনো পূণ্যতা অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় জিনিস থেকে দান করো।’ আর আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ হচ্ছে বাইরুহা বাগানটি। তাই আমি এটিকে আল্লাহর পথে সদকা করলাম। আমি চাই এর বিনিময়ে পূণ্য ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে। হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী এটি যেখানে উপযুক্ত মনে করেন, সেখানে ব্যয় করুন”।
রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বললেন: “অসাধারণ! এটা লাভজনক সম্পদ, এটা লাভজনক সম্পদ! আমি তা শুনেছি। আর আমি মনে করি, তুমি এটা তোমার আত্মীয়দের মাঝে বিতরণ করো।”
আবু তলহা (রাঃ) বললেন: “ঠিক আছে, হে আল্লাহর রাসূল!”
এরপর তিনি তা তাঁর আত্মীয়স্বজন ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। এই হাদিসটি সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিম উভয় কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। (তাফসীর ইবনু কাসীর: ২/৭৩) ।
তৃতীয় ঘটনা:
ইবনু আবি হাতিম মুহাম্মদ ইবনুল মুনকাদির (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন: যখন কুরআনের উল্লেখিত আয়াত নাযিল হলো, তখন যাইদ ইবন হারিসা (রাঃ) একটি ঘোড়া নিয়ে এলেন, যার নাম ছিল “সাবাল”, এবং সেই ঘোড়াটিই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ। তিনি এসে বললেন: “এটি আল্লাহর রাস্তায় সদকা স্বরূপ”।
রাসূলুল্লাহ ﷺ তা গ্রহণ করলেন এবং সেটিতে নিজের ছেলে উসামা (রাঃ)- কে আরোহন করালেন। তখন যাইদ (রাঃ)-এর মনে কিছুটা কষ্ট বা দুঃখ অনুভূত হলো, যেহেতু প্রিয় জিনিসটি নিজ ছেলের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তা লক্ষ্য করলেন এবং বললেন: “জেনে রেখো, আল্লাহ নিশ্চয়ই এই দান কবুল করে নিয়েছেন”। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/২১২) ।
চতুর্থ ঘটনা:
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমার (রা.) বলেন: উল্লেখিত আয়াত অবতীর্ণ হলে আমি চিন্তা করলাম আল্লাহ তাআলা আমাকে যা দিয়েছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কী? আমি দেখলাম, আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো মারজানাহ নামের এক রোমান দাসী। তখন আমি তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে স্বাধীন করে দিলাম। এরপর আমি ভাবলাম, যদি আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোনো কিছু উৎসর্গ করার পর তা ফিরিয়ে নিতে চাইতাম, তাহলে আমি তাকে বিয়ে করে ফেলতাম। কিন্তু আমি তা করিনি; বরং আমি তাকে নাফি’ এর সাথে বিবাহ দিয়েছি, যাকে আমি আমার নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতাম। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/২১২) ।

আয়াতের শিক্ষা:
১। উল্লেখিত আয়াতে দুইটি বিষয় কথা বলা হয়েছে:
(ক) বান্দার প্রিয় বস্তু ছাড়া কোন দানকে আল্লাহ কবুল করেন না, এটি আল্লাহ প্রদত্ব একটি ফর্মূলা, আল্লাহ তায়ালা কারো দান কবুল করেছেন, এ মর্মে নিশ্চয়তা পেতে হলে বান্দাকে অবশ্যই তার কাছে প্রিয় বস্তুটিকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে হবে। এ জন্য সালাফদের কাছে যখন কোন জিনিস প্রিয় মনে হতো, তখন তা আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দিতেন। এ বিষয়ে চার জন সাহাবীর দৃষ্টান্ত ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের সমাজের বেশীর ভাগ মানুষ আল্লাহ প্রদত্ব এ নিয়মকে উল্টিয়ে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবে দেখা যায়, যে জিনিসটি তার কাছে অতিরিক্ত বা মূল্যহীন তা আল্লাহর পথে দান করে দেয়। যেমন: কেউ আল্লাহর পথে কোন কিছু দান করতে চাইলে সে অনুসন্ধান করে কোন জিনিষটি তার প্রয়োজন নেই, সেই জিনিষটি আল্লাহর পথে ব্যয় করে। অনুরুপভাবে কারো একাধিক সন্তান থাকলে তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম মেধাবী এবং অকেজো সন্তানটিকে দীনী শিক্ষার জন্য মানত করে। এ জাতীয় মানুষের সংশোধনের জন্য অত্র আয়াতে শিক্ষা রয়েছে। (আল্লাহই ভালো জানেন)
(খ) বান্দা যা ব্যয় করে, তা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সম্যক জ্ঞাত, অর্থাৎ: সে কি তার প্রিয় বস্তু আল্লাহর পথে দান করছে নাকি তার অপ্রয়োজনীয় জিনিষটি দায়সারাভাবে দান করেছে, সে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা জ্ঞান রাখেন। যদি সে তার প্রিয় বস্তু দান করে থাকে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন। অন্যথায় আল্লাহ তায়ালা তার দানের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। (তাফসীর আবি সাউদ: ২/৫৮) । এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা বাক্বারার ২৬৭নং আয়াতে বলেছেন:
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ وَلَسْتُمْ بِآخِذِيهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوا فِيهِ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ﴾ [سورة البقرة: ২৬৭].
অর্থাৎ: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা অর্জন করেছো এবং আমি যমীন থেকে যা তোমাদেরকে দান করেছি তার থেকে উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করো। নিকৃষ্টতম জিনিসগুলো বেছে রেখে তার থেকে ব্যয় করো না, যা অন্যরা তোমাদেরকে দিলে তোমরা গ্রহণ করতে না। তবে অনিচ্ছকৃতভাবে হলে আলাদা কথা। আর জেনে রেখো, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের দানের প্রতি মুখোপেক্ষী নন, সকল প্রশংসার মালিক তো তিনিই” (সূরাতু আল-বাক্বারা: ২৬৭) ।
২। উল্লেখিত আয়াতে সকল সম্পদ আল্লাহর পথে দান করতে বলা হয়নি, কারণ আয়াতের দুইটি অংশেই ‘মিন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা আংশিক সম্পদের উপর দালালত করে। এ বিষয়ে সূরাতু আল-ফুরকানে জান্নাতীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে একটি আয়াতে বলা হয়েছে, তারা দানের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে:
﴿وَالَّذِينَ إِذا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكانَ بَيْنَ ذلِكَ قَواماً﴾ [سورة الفرقان: ৬৭].
অর্থাৎ: “এবং যারা ব্যয় করার ক্ষেত্রে অপচয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না, বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে” (সূরাতু আল-ফোরকান: ৬৭) ।
৩। এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে, “তোমাদের কাছে যা প্রিয়” আয়াতাংশ দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে ‘তাফসীর আবি সাউদ’ এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, শব্দটি ব্যাপকার্থে এসেছে, শুধু টাকাকড়ির ভিতরে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, বরং সদাকার যত রুপ হতে পারে, সকল রুপকে বুঝানো হয়েছে (তাফসীর আবি সাউদ: ২/৫৭) । যেমন: কাউকে কোন কিছু হাদিয়া প্রদানের ক্ষেত্রে পছন্দনীয় ও মানানশীল জিনিস হাদিয়া দেওয়া, দান করার ক্ষেত্রে উত্তম জিনিস দান করা, কাউকে কোন বিষয়ে উপকার করতে চাইলে আন্তরিকভাবে নিজের মনে করে উপকার করা, কাউকে সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা, কাউকে আপ্যায়নের ক্ষেত্রে সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেষণ করা ইত্যাদি। এক কথায়, একজন মুসলিম অন্যের জন্য এমন কিছু করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে। এ বিষয়ে আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ” (صحيح البخاري: ১৩).
অর্থাৎ: “তোমাদের কেউ পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তাই ভালোবাসবে, যা সে নিজের জন্য ভালোবাসে” (সহীহ আল-বুখারী: ১৩) ।

আয়াতের আমল:
১। একজন প্রকৃত মুসলিম সর্বদা আল্লাহর পথে নিজের পছন্দের জিনিস ব্যয় করবে।
২। সে আল্লাহর পথে কি ধরণের জিনিস ব্যয় করছে, সবকিছু আল্লাহ তায়ালা জানেন, এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে দান করা উচিৎ।

সূরাতু আলে-ইমরানের (৮৬-৯১) আয়াতাবলীর তাফসীর, আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: তাওবার দৃষ্টিভঙ্গিতে মুরতাদের শ্রেনীবিন্যাস ও তাদের শাস্তি

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿كَيْفَ يَهْدِي اللَّهُ قَوْمًا كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ وَشَهِدُوا أَنَّ الرَّسُولَ حَقٌّ وَجَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ (86) أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ أَنَّ عَلَيْهِمْ لَعْنَةَ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ (87) خَالِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ (88) إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ (89) إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَنْ تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الضَّالُّونَ (90) إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْ أَحَدِهِمْ مِلْءُ الْأَرْضِ ذَهَبًا وَلَوِ افْتَدَى بِهِ أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ (91)﴾ [سورة آل عمران: 86-91] 

 

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: তাওবার দৃষ্টিভঙ্গিতে মুরতাদের শ্রেনীবিন্যাস ও তাদের পরিণতি

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৮৬। যারা ঈমানের পর, এ কথা সাক্ষ্য দানের পর যে নিশ্চয় রাসূল হক্ব এবং তাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ আসার পর কুফরী করেছে আল্লাহ সে কাওমকে হেদায়েত দিবেন না, আর আল্লাহ যালিম কওমকে হেদায়েত দেন না।
৮৭। নিশ্চয় এরাই তারা যাদের প্রতিদান হলো: নিশ্চয় তাদের উপর আল্লাহর লা’নত, মালাইকার (লা’নত) এবং সকল মানুষের (লা’নত)।
৮৮। তারা সেখানে স্থায়ী হবে, তাদের থেকে আযাব শিথিল করা হবে না এবং না তাদেরকে অবকাশ দেওয়া হবে।
৮৯। কিন্তু এরপরে যারা তাওবা করে এবং শুধরে নেয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
৯০। নিশ্চয় যারা ঈমান আনার পর কাফের হয়েছে, অতপর কুফরীকে বাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের তাওবা কখনও কবুল করা হবে না; আর তারাই পথভ্রষ্ট।
৯১। নিশ্চয় যারা কাফির হয়েছে এবং কাফের অবস্থায় মারা গিয়েছে, তাদের থেকে যমীনপূর্ণ স্বর্ণ মুক্তিপণ দেওয়া হলেও তা কবুল করা হবে না, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং নেই কোন সাহায্যকারী।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
আল্লাহ তায়ালা উল্লেখিত আয়াতে, মুরতাদের তাওবা করে ইসলামে ফিরে আসা না আসার ব্যাপারে তিনটি অবস্থা এবং তাদের পরিণতির বর্ণনা দিয়েছেন:
(১) যারা ইসলাম ত্যাগ করে কাফের হওয়ার পর তাওবা করে ইসলামে ফিরে আসে না, এবং অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, এদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: যারা মোহাম্মদ (সা.) এর উপর ঈমান আনায়ন করেছিল, তাকে রাসূল হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছিল এবং তাদের কাছে তার নবী-রাসূল হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণও রয়েছে, অতঃপর তাকে অস্বীকার করে মুরতাদ হয়ে যায় এবং এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। তাদের জন্য শাস্তি হলো:
(ক) আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে হেদায়েত দান করবেন না। এটা এক ধরণের অত্যাচারী আচরণ, আর এ ধরণের যালিম সম্প্রদায়কে আল্লাহ তায়ালা হেদায়েতের তাওফীক দেন না।
(খ) তাদের উপর আল্লাহ তায়ালার অভিশাপ, ফেরেশতাদের অভিশাপ এবং সকল মানুষের অভিশাপ।
(গ) তারা এ অভিশাপের মধ্যে চিরকাল থাকবে।
(ঘ) তারা যদি আখেরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য যমীনপূর্ণ স্বর্ণ মুক্তিপণ হিসেবে দিতে চায় তাও তাদের পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না।
(ঙ) তাদের জন্য জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।
(চ) কিয়ামাতের দিন তাদের পক্ষে কোন সাহায্যকারী পাওয়া যাবে না।

(২) যারা ইসলাম ত্যাগ করে কাফের হওয়ার পর তাওবা করে পুনরায় ইসলামে ফিরে আসে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: কিন্তু কেউ যদি ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরে তাওবা করে পুনরায় ইসলামে ফিরে আসে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয়। তাদের প্রতিদান হলো: আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন।

(৩) যারা ইসলাম ত্যাগ করে কাফের হওয়ার পর মৃত্যুর সময় তাওবা করে ইসলামে ফিরে আসার চেষ্ট করে, এদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: নিশ্চয় যারা ইসলাম গ্রহণের পর পুনরায় কাফের হয়েছে, অতপর সারা জীবন কুফরের উপর ছিল। অবশেষে মৃত্যুর সময় তাওবা করার চেষ্টা করে। তাদের পরিণতি হলো:
(ক) তাদের তাওবা কবুল করা হবে না এবং
(খ) তারা পথভ্রষ্ট হিসেবে পরিগণিত হবে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৯০-২৯১, আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৪৩, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৬১, আল-মোন্তাখাব: ১/১০০) ।

উল্লেখিত আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতের সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে আলোচনা করা হয়েছে যে, সকল নবী-রাসূলের একমাত্র বাচাইকৃত ধর্ম ইসলাম, যারা এ দীনকে বাদ দিয়ে অন্য কোন দীন তালাশ করবে, তা আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে যারা আল্লাহ তায়ালার বাচাইকৃত ধর্ম ইসলাম থেকে বেড়িয়ে গিয়ে অন্য কোন ধর্মের অনুসরণ করবে, তাদের অবস্থা ও শাস্তির বর্ণনা এসেছে। সুতরাং উল্লেখিত আয়াতাবলীর সাথে সাথে পূর্বের আয়াতের সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/২০৫) ।

(৮৬-৯০) নাম্বার আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
ইমাম নাসায়ী, ইবনু হিব্বান এবং হাকিম (র.) ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, একজন আনসার ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিল, এরপর সে ধর্ম ত্যাগ করে, অতঃপর অনুতপ্ত হয়। সে তার আত্মীয়-স্বজনকে বলেছিল: তোমরা রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে লোক পাঠিয়ে জিজ্ঞাসা করো আমার জন্য কি তাওবা করার সুযোগ আছে? তখন (৮৬-৮৯) আয়াতাবলী অবতীর্ণ করা হয়। এরপর তার আত্মীয়-স্বজন রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে এ বর্তাটি পাঠালো, তখন সে আবার ইসলাম গ্রহণ করলো।
মুসাদ্দাদ তার মুসনাদে এবং আব্দুর রাজ্জাক (র.) মুজাহিদ (র.) থেকে বর্ণনা করেছেন, হারিস ইবনু সুয়াইদ নামক এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন, কিন্তু পরে মুরতাদ হয়ে পূর্বের ধর্মে ফিরে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা (৮৬-৮৯) আয়াতাবলী অবতীর্ণ করেন। তার আত্মীয়-স্বজনের এক ব্যক্তি এই আয়াত পাঠ করলেন। তখন হারিস বললেন: আল্লাহর কসম, তুমি একজন সত্যবাদী, রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমার চেয়েও বেশী সত্যবাদী, আর আল্লাহ তো এ তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সত্যবাদী। এরপর সে ফিরে এসে একনিষ্ঠভাবে ইসলাম গ্রহণ করলো। (লুবাব আল-নুক‚ল: ৬৬) ।
হাসান আল বাসরী এবং কাতাদা (র.) বলেন: অত্র আয়াত ইহুদীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। কারণ, তারা নবী মোহাম্মদের (সা.) আগমণের সুসংবাদ দিত এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে তার আগমণের মাধ্যমে বিজয় কামনা করতো। কিন্তু যখন তারা দেখলো তিনি (সা.) বাস্তবে অন্য গোত্র থেকে প্রেরিত হয়েছেন, তখন তারা জিদ, হিংসা ও বিরোধিতা করে তার সাথে কুফরি করতে শুরু করলো। তখন আল্লাহ তায়ালা “তাদের প্রতিদান হলো: তাদের উপর আল্লাহর লা’নত, ফেরেশাকুলের লা’নত এবং সকল মানুষের লা’নত” এ আয়াত অবতীর্ণ করলেন। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/২৮৮) ।
হাসান, কাতাদাহ এবং আতা আল-খুরাসানী (র.) বলেন, ৯০নং আয়াত ইহুদীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা মূসার (আ.) প্রতি ঈমান এনেছিল, অতঃপর ঈসার (আ.) আগমণ হলে তাকে অস্বীকার করে কাফের হয়ে যায়। অবশেষে মোহাম্মদের (সা.) আগমণ হলে তাকে অস্বীকার করার মাধ্যমে তাদের কুফরীকে আরা বাড়িয়ে নেয়। (আসবাব আল-নুযূল, ওয়াহেদী: ১১৮) ।
ইমাম জুহাইলী (র.) বলেন: একটি আয়াত অবতীর্ণের একাধিক প্রেক্ষাপট হওয়াতে কোন বাধা নেই। যদিও ইমাম তবারী (র.) সহ জমহুর মুফাসসিরীন উল্লেখিত আয়াত অবতীর্ণের দ্বিতীয় প্রেক্ষাপটকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/২৮৯) ।

সূরা আলে-ইমরানের (৮৬-৯১) আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। মুরতাদ বলা হয় তাদেরকে, যারা বুঝে-শুনে ইসলাম গ্রহণের পর ইসলাম ছেড়ে পুনরায় কাফির হয়ে যায় (মু’জাম আল-মুস্তালিহাত, ড. মাহমুদ: ৩/২৫৯) । বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থ ও আসবাব আল-নুযূল থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, উল্লেখিত আয়াতাবলীতে দুই প্রকার মুরতাদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে:
(ক) যারা রাসূলুল্লাহর (সা.) রিসালাতের সত্যতা জেনে এবং এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পর ইসলাম গ্রহণ করেছে। অতঃপর ইসলাম থেকে বের হয়ে পুনরায় কাফের হয়ে গিয়েছে।
(খ) যারা মূসা (আ.) ও তাওরাতের প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে। অতঃপর ঈসা (আ.) ও ইনজীলকে অস্বীকার করে কাফের হয়েছে। সর্বশেষ মোহাম্মদ (সা.) ও কোরআনকে অস্বীকার করার মাধ্যমে তাদের কুফরীকে বৃদ্ধি করেছে।
২। (৮৬-৯১) নাম্বার আয়াতাবলীতে উল্লেখিত দুই প্রকার মুরতাদের তিনটি অবস্থা এবং পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আলোচনা করেছেন। ৮৬, ৮৭, ৮৮ এবং ৯১ নাম্বার আয়াতে মুরতাদের প্রথম অবস্থা এবং এর পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম অবস্থা হলো: তারা মুরতাদ হওয়ার পরে তাওবা না করে কাফির অবস্থায় মারা যায়। তাদের পাঁচটি পরিণতি হলো:
(ক) আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কখনও হেদায়েতের তাওফীক দিবেন না।
(খ) তারা চিরকাল আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাকুল এবং সকল মানুষের অভিশাপে পতিত হবে।
(গ) তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য যমীনপূর্ণ স্বর্ণ মুক্তিপণ দিলেও তা গ্রহণ করা হবে না।
(ঘ) তাদের জন্য জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।
(ঙ) কিয়ামাতের দিন তাদের পক্ষে কোন সাহায্যকারী পাওয়া যাবে না।
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে মুরতাদের আরেকটি শাস্তি পাওয়া যায়। আর তা হলো: মৃত্যুদন্ড। যেমন হাদীসে এসেছে:
عن ابن عباس، عن النبي -صلى الله عليه السلام- قال: “مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ” (صحيح البخاري: ৬৯২২).
অর্থাৎ: ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি তার দীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করো” (সহীহ আল-বুখারী: ৬৯২২) । আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“لا يحل دم امرئ مسلم يشهد أن لا إله إلا الله وأني رسول الله إلا بإحدى ثلاث: النفس بالنفس، والثيب الزاني، والتارك لدينه المفارق للجماعة” (صحيح البخاري: ৬৮৭৮).
অর্থাৎ: “কোন মুসলিম যদি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, তিনটি কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করা বৈধ নয়। জানের বদলে জান, বিবাহিত ব্যভিচারী এবং নিজের দীন ত্যাগকারী মুসলিম জামায়াত থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া ব্যক্তি” (সহীহ আল-বুখারী: ৬৯২২) ।
৩। ৮৯নং আয়াতে মুরতাদের দ্বিতীয় অবস্থা এবং পুরস্কারের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থা হলো: মুরতাদ হওয়ার পরে নিয়মতান্ত্রিক তাওবা করে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে নিয়ে ইসলামের পথে ফিরে আসে। তাওবা কিভাবে করবে? তাওবার নিয়ম কি? সে বিষয়ে আলোচনা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। আর তাদের পুরস্কার হলো: আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মাফ করে দিবেন।
৪। ৯০নং আয়াতে মুরতাদের তৃতীয় অবস্থা এবং পরিণতির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অবস্থা হলো: মুরতাদ হওয়ার পর তাওবার অপেক্ষা করতে করতে মৃত্যুর সময় চলে আসার পরে তাওবা করা। তাদের পরিণতি হলো:
(ক) তাদের তাওবা কবুল করা হবে না এবং
(খ) তারা পথভ্রষ্ট হিসেবে পরিগণিত হবে। (আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন) ।
এ সম্পর্কে সূরা নিসা এর ১৭ ও ১৮ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
﴿إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهالَةٍ، ثُمَّ يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ، فَأُولئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ، وَكانَ اللَّهُ عَلِيماً حَكِيماً. وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئاتِ، حَتَّى إِذا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ، قالَ: إِنِّي تُبْتُ الْآنَ، وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ، أُولئِكَ أَعْتَدْنا لَهُمْ عَذاباً أَلِيماً﴾ [سورة النساء: ১৭-১৮].
অর্থাৎ: “নিশ্চয় তাওবা তাদের জন্য, যারা অজ্ঞাতবশত খারাপ কাজ করে; অতঃপর কালক্ষেপণ না করে তাওবা করে। আল্লাহ তায়ালা তাদের তাওবা কবুল করেন। আল্লাহ তায়ালা মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। আর তওবা তাদের জন্য নয়, যারা পাপ কাজ করে, অতঃপর তাদের কারো কাছে মৃত্যু আসলে বলে: আমি এখন তাওবা করছি। এবং তাওবা তাদের জন্যও নয়, যারা কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। বস্তুত আমি তাদের জন্য যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি” (সূরাতু আন-নিসা: ১৭-১৮) ।
৫। কেউ ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হলে দুনিয়া ও আখেরাতে তার শাস্তি কি হবে, সে বিষয়ে উল্লেখিত আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে। এখন একটি প্রশ্ন হতে পারে, কি কাজ করিলে একজন মুসলিম মুরতাদ হয়ে যাবে? এ সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম চারটি বিষয় উল্লেখ করেছেন, যার কোন একটি একজন সুস্থ-স্বাভাবিক, প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবান মুসলিম থেকে সংগঠিত হলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে এবং তাওবা করে ইসলমে ফিরে না আসলে আয়াত এবং হাদীসে বর্ণিত শাস্তি তাদের ক্ষেত্রে প্রজোয্য হবে।
(ক) বিশ্বাসগতভাবে মুরতাদ হয়ে যাওয়া, যেমন: আল্লাহর সাথে শিরক করা, আল্লাহকে অস্বীকার করা, তাঁর কোন প্রমাণিত গুণ অস্বীকার করা, আল্লাহর জন্য সন্তান স্থির করা ইত্যাদির যে কোন একটি কারো থেকে সংগঠিত হলে, সে মুরতাদ কাফির।
(খ) কাথাবার্তার মাধ্যমে মুরতাদ হয়ে যাওয়া, যেমন: আল্লাহ তায়ালাকে গালি দেওয়া এবং রাসূলুল্লাহকে (সা.) গালি দেওয়া।
(গ) কার্যকলাপের মাধ্যমে মুরতাদ হয়ে যাওয়া, যেমন: কোরআনুল কারীমকে অপবিত্র স্থানে নিক্ষেপ করা, এটা আল্লাহর বাণীর প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের প্রতীক, যা বিশ্বাস না করার লক্ষণ। অনুরুপভাবে মুর্তি পুজা করা, সূর্য বা চাদের সামনে সিজদা করা।
(ঘ) পরিত্যাগ করার মাধ্যমে মুরতাদ হয়ে যাওয়া, যেমন: দীনের সব আমল পরিত্যাগ করা এবং দীন থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। (আল-মাওসূআহ আল-ফিকহিয়্যাহ: ২২/১৮০) । আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনীতিবিদ, বিচারক, ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে মুরতাদ হওয়ার উল্লেখিত কারণগুলো পরিলক্ষিত হয়। এ জন্য বর্ণিত আয়াতাবলী থেকে আমাদের সকলের শিক্ষা রয়েছে।

আয়াতাবলীর আমল:
১। একজন মুসলিম সর্বদা দীন বিধ্বংসী আমল থেকে নিজেকে সংরক্ষণ করবে।
২। কেউ উল্লেখিত দীন বিধ্বংসী আমল করার মাধ্যমে দীন থেকে মুরতাদ হলে দেশের সরকার তার উপর ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করবে।
৩। নিজের অজান্তে ইসলাম বিধ্বংসী কোন কাজ করে ফেললে, কালক্ষেপণ না করে সাথে সাথে তাওবা করবে।

সূরাতু আলে ইমরানের (৮৪-৮৫) আয়াতদ্বয়ের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: সকল নবী-রাসূলকে মেনে নেয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿قُلْ آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ عَلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَى وَعِيسَى وَالنَّبِيُّونَ مِنْ رَبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ (84) وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ (85)﴾ [سورة آل عمران: 84-85]

 

আয়াতদ্বয়ের আলোচ্যবিষয়: সকল নবী-রাসূলকে মেনে নেয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ।

আয়াতদ্বয়ের সরল অনুবাদ:
৮৪। হে আল্লাহর নবী! তোমার উম্মত যেন বলে: আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি, যা অবতীর্ণ করা হয়েছে আমাদের প্রতি, যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়ক‚ব, ও তাদের বংশধরদের প্রতি এবং তাদের রবের পক্ষ থেকে যা প্রদান করা হয়েছে মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে, আমরা তাদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমার্পণকারী।
৮৫। আর যে ব্যক্তি ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, তা কখনও তার পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখেরাতে খতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে।

আয়াতদ্বয়ের ভাবার্থ:
ইহুদী-খৃষ্টানরা মোহাম্মদ (সা.) এবং কোরআনকে অস্বীকার করার মাধ্যমে কাফির হয়ে গেছে, তাদেরকে তিরস্কার করার পর এবার আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তার উম্মতকে শিক্ষা দিচ্ছেন যে ইহুদী-খৃষ্টানরা যাই বলুক না কেন, মুসলমানরা যেন বলে: আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি, আমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তার প্রতি ঈমান এনেছি। এমনকি ইহুদী-খৃষ্টানদের নবী মূসা ও ঈসাকে (আ.) এবং অন্যান্য সকল নবীদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তার প্রতিও আমরা ঈমান এনেছি। আমরা তাদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না, কারণ আল্লাহর জন্য আমরা নিজেদেরকে পুরোপুরি উৎসর্গ করে দিয়েছি। সুতরাং আমাদের জন্য তাঁর নির্দেশের বাহিরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।

মোহাম্মদ (সা.) রাসূল হিসেবে প্রেরিত হবার পর যে ব্যক্তি ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ধর্মকে তালাশ করবে, আল্লাহ তায়ালার কাছে তা কখনও গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সে আখেরাতে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৪০-৩৪১, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৬১, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৯) ।

আয়াতদ্বয়ের বিরল শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿وَالْأَسْبَاطِ﴾ ‘এবং বংশধর’, আয়াতাংশে ‘আল-আসবাত’ শব্দটি আরবী, ‘সাবত’ এর বহুবচন। এর অর্থ হলো: গোত্র। আয়াতে ইয়াকুবের (আ.) বার পুত্র এবং তাদের বংশধরকে বুঝানো হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে তাদেরকে উল্লেখ করার কারণ হলো: ইহুদী-খৃষ্টানরা তাদের নবুয়াত ও কিতাবকে বিশ্বাস করে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/২০২) ।

﴿الْإِسْلَامِ﴾ ‘ইসলাম’, আয়াতে ইসলাম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: মানবজাতির জন্য আল্লাহ তায়ালার নির্বাচিত ধর্ম, যা চারটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে:
(ক) আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাস করা।
(খ) ইখলাসের সাথে তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করা।
(গ) তিনি তাঁর নবী-রাসূলদের মাধ্যমে যা নির্দেশ দিয়েছেন তার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য পোষণ করা।
(ঘ) সর্বশেষ নবী মোহাম্মদের (সা.) প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করা। (তাফসীর ইবনু কাসীর: ২/৭০, তাফসীর আল-মারাগী: ৩/২০২-২০৩, আল-তাফসীর আল-মোয়াসসার: ১/৬১) ।

আয়াতদ্বয়ের সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলী অর্থাৎ (৮১-৮৩) নাম্বার আয়াতে সকল নবী-রাসূল এবং উম্মত যেন মোহাম্মদ (সা.) কে নবী ও রাসূল হিসেবে গ্রহণ করে তার আলোচনা করা হয়েছে। আর উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ে মোহাম্মদ (সা.) এবং তার উম্মত সকল নবী-রাসূল ও তাদের প্রতি অবতীর্ণ হওয়া আসমানী কিতাবের উপর এমনকি মূসা ও ঈসা (আ.) এবং তাদের প্রতি অবতীর্ণ হওয়া তাওরাত-ইনজীলের প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে, এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/২৮২) ।

(৮৫) নাম্বার আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
ইমাম মুজাহিদ (র.) বলেন: অত্র আয়াত হাল্লাস ইবনু সুয়াইদ (রা.) এর ভাই আনসারী সাহাবী হারিস ইবনু সুয়াইদ (রা.) সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। বিস্তারিত ঘটনা হলো: হারিস ইবনু সুয়াইদ তার ১২(বার) জন সঙ্গী-সাথী সহ ইসলাম থেকে বেড়িয়ে গিয়ে মক্কার কাফিরদের সাথে সাক্ষাত করে। তখন তাকে সতর্ক করার জন্য আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াত অবতীর্ণ করেন। এ আয়াত অবতীর্ণের পরে হাল্লাস (রা.) তার ভাইকে তাওবা করে পুনরায় ইসলামে ফিরে আসতে বলেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: হারিস অত্র আয়াত অবতীর্ণের পর পুনরায় ইসলামে ফিরে এসেছিলেন। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/২৮৪) ।

আয়াতদ্বয়ের শিক্ষা:
১। ৮৪ নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় যে,
(ক) ইসলামী শরীয়াহ চিরস্থায়ী হওয়ার পিছনে দুইটি বড় কারণ রয়েছে:
(র) সমস্ত নবী-রাসূল ও তাদের কিতাবের প্রতি সর্বাঙ্গীন ও পূর্ণ বিশ্বাস। ইসলাম সকল নবী এবং তাদের কাছে পাঠানো কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে নির্দেশ প্রদান করেছে। এজন্য মুসলমানগণ শুধু শেষ নবী মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি নয়, বরং সকল নবী-রাসূল যেমন: ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব, মূসা এবং ঈসা (আ.) ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে। তারা সকল কিতাব যেমন: তাওরাত, ইনজীল, যাবুর ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এবং সম্মান করে থাকে। কারণ, এ সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।
(রর) আল্লাহর অস্তিত্ব ও তার একত্ববাদে বিশ্বাস রাখা, তাঁর আনুগত্যে আত্মসমর্পণ করা এবং তাঁর নির্ধারিত পথ তথা শরীয়তের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকা। ইসলাম আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাস করতে বলে। মুসলমানরা আল্লাহর আদেশ মানে, তাঁর পথ অনুসরণ করে এবং তিনি যে শরিয়ত দিয়েছেন তা মেনে চলে। এ নিয়ম সকল নবী-রাসূল মেনে চলেছেন এবং আল্লাহ এটাকেই মানবজাতির জন্য সঠিক পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এ পথে চললে মানুষ পরকালে মুক্তি পাবে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৮৬) ।
(খ) কার ঈমান অশুদ্ধ, তা বুঝার জন্য আল্লাহ তায়ালা দুইটি ফর্মূলা দিয়েছেন:
(র) কোন মানুষের ঈমান শুদ্ধ নয় যদি সে কিছু নবী-রাসূলের প্রতি ঈমান আনে এবং কিছু নবী-রাসূলকে অস্বীকার করে।
(রর) যদি কেউ আল্লাহ তায়ালা রাসূলদের উপর যে সকল আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, তার কিছু অংশের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আর কিছু অংশকে অস্বীকার করে, তাহলে তার ঈমানও শুদ্ধ নয়। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়েরী: ৩৪১) ।
২। ৮৫নং আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, কোন ব্যক্তি যদি উপরোল্লেখিত পথ তথা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) অনুসৃত ধর্মকে ছেড়ে অন্য কোন পথ অনুসরণ করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তা গ্রহণ করবেন না এবং তার জীবনের কোন কর্ম কাজে আসবে না, শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জাহান্নামে চলে যাবে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৮৬) ।
৩। সকল নবী-রাসূল একটি ধর্মের অনুসারী ছিলেন, আর তা হলো: ইসলাম। এ ব্যাপারে কোরআনের অনেক আয়াত এবং রাসূলুল্লাহর (সা.) বাণী রয়েছে:

নূহ (আ.) মুসলিম ছিলেন, এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরাতু ইউনুস এ বলেছেন:
﴿فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَمَا سَأَلْتُكُمْ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ﴾ [سورة يونس: ৭২].
অর্থাৎ: “অতএব তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে জেনে রেখ তোমাদের কাছে দাওয়াতের বিনিময়ে কিছু চাই না, তা কেবল আল্লাহর কাছেই চাই। আর আমিতো মুসলিম হওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি” (সূরাতু ইউনুস: ৭২) ।

ইব্রাহীম (আ.) মুসলিম ছিলেন, এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরাতু আলে ইমরানে বলেছেন:
﴿مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾ [سورة آل عمران: ৬৭].
অর্থাৎ: “ইব্রাহীম (আ.) ইহুদী-খৃষ্টান ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ মুসলিম। এমনকি তিনি মুশরিকদেরও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না” (সূরাতু আলে ইমরান: ৬৭) ।

ইয়াকুব (আ.) মুসলিম ছিলেন, এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
﴿وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ﴾ [سورة البقرة: ১৩২].
অর্থাৎ: “আর ইব্রাহীম (আ.) তার সন্তানদেরকে ইসলাম গ্রহণের অসিয়ত করেছেন এবং ইয়াকুব (আ.) তার বংশধরকে এ বলে অসিয়ত করেছেন যে, হে আমার সন্তানেরা, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য এ দীনকে চয়ন করেছেন। সুতরাং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না” (সূরাতু আল-বাক্বারা: ১৩২) ।

ইউসূফ (আ.) মুসলিম ছিলেন, এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
﴿أَنْتَ وَلِيِّي فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ﴾ [سورة يوسف: ১০১].
অর্থাৎ: “ইউসুফ (আ.) বললেন: আপনি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার অভিভাবক, আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দিয়েন এবং সৎপরায়ণদের সাথে সাক্ষাত করিয়ে দিয়েন” (সূরাতু ইউসুফ: ১০১) ।

মূসা (আ.) মুসলিম ছিলেন, এ সম্পর্কে কোরআনে এসেছে:
﴿وَقَالَ مُوسَى يَا قَوْمِ إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُسْلِمِينَ﴾ [سورة يونس: ৮৪].
অর্থাৎ: “এবং মূসা (আ.) বললেন: হে আমার জাতি, তোমরা যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে থাকো, তাহলে তাঁর উপর ভরসা করা উচিৎ, যদি তোমরা প্রকৃত অর্থে মুসলিম হয়ে থাকো” (সূরা ইউনুস: ৮৪) ।

সোলাইমানও (আ.) মুসলিম ছিলেন, তিনি রাণী ‘বিলকিস’ কে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং তিনি কবুল করেছিলেন। এ সম্পর্কে কোরআনে এসেছে:
﴿قَالَتْ رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ﴾ [سورة النمل: ৪৪].
অর্থাৎ: “সে বললো: হে আমার রব! নিশ্চয় আমি নিজের উপর অত্যাচার করেছি এবং আমি সোলাইমানের সাথে বিশ্বসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর কাছে আত্মসমার্পণ করলাম” (সূরাতু আন-নামল: ৪৪) ।

ইব্রাহীম (আ.) এবং তার পুত্র ইয়াকুব (আ.) নিজেরাই শুধু মুসলিম ছিলেন না, বরং তারা তাদের বংশধরকে মুসলিম হওয়ার জন্য অসিয়ত করে গিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরাতু আল-বাক্বারার ১৩২নং আয়াতে বলেছেন:
﴿وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ﴾ [سورة البقرة: ১৩২].
অর্থাৎ: “আর ইব্রাহীম (আ.) তার সন্তানদেরকে ইসলাম গ্রহণের অসিয়ত করেছেন এবং ইয়াকুব (আ.) তার বংশধরকে এ বলে অসিয়ত করেছেন যে, হে আমার সন্তানেরা, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য এ দীনকে চয়ন করেছেন। সুতরাং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না” (সূরাতু আল-বাক্বারা: ১৩২) । সুতরাং বনী ইসরাঈল এবং তাদের মধ্যে যত নবী-রাসূল আগমণ করেছেন সকলেই এ অসিয়তের আওতায় পড়ে। অর্থাৎ: ইহুদী-খৃষ্টান এবং তাদের নবী ঈসা, মূসা, সোলায়মান, দাউদ (আ.) ইত্যাদি সকলকে তাদের পিতা ইয়াকুব (আ.) মুসলিম হওয়ার জন্য অসিয়ত করে গিয়েছেন। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“الْأَنْبِيَاءُ إِخْوَةٌ مِنْ عَلَّاتٍ، وَأُمَّهَاتُهُمْ شَتَّى، وَدِينُهُمْ وَاحِدٌ، فَلَيْسَ بَيْنَنَا نَبِيٌّ” (صحيح مسلم: ২৩৬৫).
অর্থাৎ: ভিন্ন ভিন্ন মায়ের সন্তান হওয়া সত্বেও সকল নবী-রাসূলগণ ভাইয়ের মত এবং তাদের ধর্ম এক। আমার এবং ঈসার (আ.) মধ্যে কোন নবী নেই। (সহীহ মুসলিম: ২৩৬৫) ।

আয়াতদ্বয়ের আমল:
১। সকল নবী-রাসূলদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। বিশেষ করে ইহুদী-খৃষ্টানদের উচিৎ মোহাম্মদ (সা.) সহ সকল নবী-রাসূলদেরকে সম্মান দেখানো এবং তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
২। ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ধর্মকে তালাশ না করা।

সূরাতু আলে-ইমরান এর (৮১-৮৩) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: নবী-রাসুলদের পারস্পরিক সম্পর্ক।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي قَالُوا أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِينَ (81) فَمَنْ تَوَلَّى بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (82) أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ (83)﴾ [سورة آل عمران: 81-83]

 

আয়াতের আলোচ্যবিষয়: নবী-রাসুলদের পারস্পরিক সম্পর্ক।

আয়াতের সরল অনুবাদ:
৮১। আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন যে, আমি তোমাদেরকে কিতাব এবং হিকমাত দিয়েছি, অতঃপর তোমাদের সাথে যা আছে তার সত্যায়নের জন্য তোমাদের কাছে একজন সত্যায়নকারী রাসূল আসবে। তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন: তোমরা কি আমার অঙ্গীকার গ্রহণ করলে এবং মেনে নিলে? তারা বললো: মেনে নিলাম, তিনি বললেন: তবে তোমরা সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম।
৮২। সুতরাং অঙ্গীকার গ্রহণ এর পরে যারা ফিরে যাবে, তারাই হবে ফাসিক।
৮৩। আল্লাহর নির্বাচিত ধর্মের পরিবর্তে তারা কি অন্য কোন ধর্ম চায়? অথচ আসমান-যমীনের সবকিছু ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় তাঁরই জন্য আত্মসমার্পণ করে, এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাবে।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
রাসূলুল্লাহকে (সা.) সম্বোধন করে বলা হয়েছে: আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলদের থেকে যে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন, তা যেন তিনি তার উম্মত ও নাজরান থেকে আগত খৃষ্টানদেরকে জানিয়ে দেন। অঙ্গীকারের রুপরেখা হলো: আল্লাহ তায়ালা যখনই কাউকে নবী হিসেবে নির্বাচন করতেন, তখন প্রথমেই তার থেকে এ মর্মে ওয়াদা গ্রহণ করতেন যে, তার জীবদ্দশায় অথবা নবুয়াতকালে মোহাম্মদের (সা.) আগমণ ঘটলে, তার নিজস্ব দাওয়াতি কাজ বাদ দিয়ে মোহাম্মদের প্রতি ঈমান গ্রহণ করবে এবং তাকে দাওয়াতী কাজে সাহায্য করবে। আর তাদের সময়ে মোহাম্মদের (সা.) আগমণ না হলে, তাদের উম্মত যেন তার প্রতি ঈমান আনে এবং তাকে সাহায্য করে মর্মে ওসিয়ত করে যাবে। এভাবে আদম (আ.) হতে আরম্ভ করে ঈসা (আ.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল থেকে আল্লাহ তায়ালা অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন এবং তারা সকলেই এ প্রতিশ্রæতিতে আবদ্ধ হয়েছে। এ ওয়াদার উপর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সাক্ষী রেখেছেন এবং তিনি নিজেও সাক্ষী রয়েছেন।
সুতরাং যারা এ অঙ্গীকার গ্রহণ করার পর তা অস্বীকার করে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তারা আল্লাহ প্রদত্ব ওয়াদা এবং তাদের নবীর ওসিয়ত ভঙ্গ করার কারণে ফাসিক হিসেবে পরিগণিত হবে। ইহুদীখৃষ্টানরা এ অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করে আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতায় পতিত হয়েছে, কারণ তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং কোরআনকে অস্বীকার করেছে।
অতঃপর ইহুদীখৃষ্টানদেরকে তিরস্কারপূর্বক বলা হয়েছে, তারা কি আল্লাহ তায়ালার নির্বাচিত ধর্ম ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ধর্ম তালাশ করছে? অথচ আসমান-যমীনের সবকিছুই ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ করছে এবং সবকিছুই বিচারের কাঠগড়ায় দাড়ানোর জন্যে তাঁরই দিকে ফিরে যাচ্ছে। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৪০-৩৪১, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৬০, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৯) ।

আয়াতাবলীর বিরল শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿وَإِذْ﴾ ‘এবং যখন’, আয়াতাংশে কোন সময়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে? এ বিষয়ে তাফসীকারকদের থেকে দুইটি মত পাওয়া যায়:
(ক) অধিকাংশ তাফসীরকারকদের মতে, যখন কাউকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হতো, তখন প্রথমেই তার থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হতো যে, তার জীবদ্দশায় মোহাম্মদের (সা.) আগমণ ঘটলে সে নিজের দাওয়াতী মিশন বন্ধ করে দিয়ে তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে দাওয়াতি কাজে সহযোগিতা করবে। আর তার সময়ে মোহাম্মদের (সা.) আগমণ না হলে তার উম্মতকে তার প্রতি ঈমান ও সহযোগিতার জন্য অসিয়ত করে যাবে। এভাবে আদম (আ.) থেকে শুরু করে ঈসা (আ.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল থেকে বিভিন্ন সময়ে ওয়াদা গ্রহণ করেছেন। (তাফসীর ইবনু কাসীর: ২/৬৭) ।
(খ) আয়াতের সাবিক-লাহিক বা বাচনভঙ্গি থেকে বুঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা রুহের জগতে সকল নবী-রাসূল থেকে উল্লেখিত অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। যেমন:
প্রথমত: কোরআনের যত যায়গাতে ‘ইয’ বা যখন শব্দটি বলা হয়েছে, সব জায়গাতেই নির্দিষ্ট সময়ে সংগঠিত হওয়া ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: আয়াতের প্রতিটি অংশে বহুবচণের শব্দ ব্যবহার করে সম্বোধন করা হয়েছে।
তৃতীয়ত: আল্লাহ তায়ালা যখন সকল নবী থেকে স্বীকৃতি গ্রহণ করেছিলেন, তখন সবাই সমস্বরে স্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

﴿مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ﴾ ‘নবীদের থেকে অঙ্গীকার’, নবীদের থেকে কোন বিষয়ের উপর অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছিল? এ বিষয়ে তিনটি কথা পাওয়া যায়:
(ক) একজন নবীর জীবদ্দশায় কোন নবীর আগমণ ঘটলে সে নিজের দাওয়াতী মিশন বন্ধ করে দিয়ে পরবর্তী নবীর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে দাওয়াতি কাজে সহযোগিতা করবে, যা ৮১নং আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
(খ) তাউস এবং হাসান বসরী (রা.) বলেন: সকল নবী একে অপরের প্রতি ঈমান আনয়ন করবে এবং পরস্পরকে সত্যায়ন করবে। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/১২৪) ।
(গ) আলী (রা.) বলেন: একজন নবীর জীবদ্দশায় মোহাম্মদের (সা.) আগমণ ঘটলে সে নিজের দাওয়াতী মিশন বন্ধ করে দিয়ে তার প্রতি ঈমান আনবে এবং দাওয়াতি কাজে সহযোগিতা করবে। (তাফসীর ইবনু কাসীর: ২/৬৭) ।
ইবনু কাসীর (র.) বলেন: উল্লেখিত তিনটি মতের মধ্যে বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিরোধ পরিলক্ষিত হলেও মূলত তাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, বরং একটি মত আরেকটি মতকে আরো শক্তিশালী করে। (তাফসীর ইবনু কাসীর: ২/৬৮) ।

﴿رَسُولٌ﴾ ‘রাসূল’, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ ব্যাপারে তাফসীরকারকদের থেকে দুইটি মত পাওয়া যায়:
(ক) আয়াতে ‘রাসূল’ দ্বারা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত যে কোন রাসূলকে বুঝানো হয়েছে, নির্দিষ্টভাবে কাউকে বুঝানো হয়নি। এ ক্ষেত্রে আয়াতের অর্থ হবে: আল্লাহ তায়ালা সকল নবী-রাসূল থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন যে, তাদের জীবদ্দশায় কোন রাসূল প্রেরিত হলে, তারা তার প্রতি ঈমান আনবে ও সহযোগিতা করবে। আর তাদের সময়ে আগমণ না হলে, তাদের উম্মতকে তার প্রতি ঈমান ও সহযোগিতার অসিয়ত করে যাবে।
(খ) আয়াতে ‘রাসূল’ দ্বারা মোহাম্মদকে (সা.) বুঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আয়াতের অর্থ হবে: আল্লাহ তায়ালা সকল নবী-রাসূল থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন যে, তাদের জীবদ্দশায় মোহাম্মদ (সা.) প্রেরিত হলে, তারা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং সহযোগিতা করবে। আর তাদের সময়ে তার আগমণ না হলে, তাদের উম্মতকে তার প্রতি ঈমান ও সহযোগিতার অসিয়ত করে যাবে। (তাফসীর ইবনু কাসীর: ২/৬৭) ।

﴿إِصْرِي﴾ ‘আমার অঙ্গীকার’, আয়াতাংশে ‘ইসরি’ আরবী শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ হলো: ভারী বা কঠিন। এটাকে অঙ্গীকার বলা হয়েছে. কারণ এটি সেই বিষয়কে বাধা দেয় যার জন্য তা নির্ধারিত হয়েছে, এবং এটি এমন একটি ভারী দায়িত্ব বা অঙ্গীকার সৃষ্টি করে যা কঠিন এবং বাধ্যতামূলক। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবা: ১/৯৬) ।

উল্লেখিত আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
অত্র সূরার (১-৮০) নাম্বার আয়াতে ইহুদী-খৃষ্টান কর্তৃক আল্লাহর বাণী বিকৃতি করা এবং তাদের কিতাবে বর্ণিত মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) গুণাবলী পরিবর্তন করার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে খেয়ানত করার কথা বণিত হয়েছে, যার মাধ্যমে উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে রাসূলুল্লাহর (সা.) রিসালাতের প্রতি বিশ্বাসী বানানো এবং তার নবুয়াত প্রতিষ্ঠিত করা। আর অত্র আয়াতাবলীতে সেই উদ্দেশ্যকে সুস্পষ্ট দলীল পেশ করার মাধ্যমে আরো সুদৃঢ় করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূল থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন যে, তাদের জীবদ্দশায় মোহাম্মদ (সা.) প্রেরিত হলে, তারা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং সহযোগিতা করবে। আর তাদের সময়ে তার আগমণ না হলে, তাদের উম্মতকে তার প্রতি ঈমান ও সহযোগিতার অসিয়ত করে যাবে। তাহলে, এ যদি হয় নবীদের চুক্তি, তবে তাদের অনুসারীদের উচিৎ সকল নবী-রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তাদের কাছে যা আছে, তা সত্যায়ন করা; কারণ তাদের সকলের ধর্ম এক ইসলাম। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/২৭৮-২৭৯) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। ৮১ নাম্বার আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে,
(ক) আদম (আ.) থেকে শুরু করে মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল এবং তাদের উম্মতরা পরস্পরের প্রতি ঈমান আনবে এবং সত্যায়ন করবে; কারণ তারা একই ধর্ম ইসলামের অনুসারী, পার্থক্য শুধু সময়, অবস্থান ও প্রেক্ষাপটে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“الْأَنْبِيَاءُ إِخْوَةٌ مِنْ عَلَّاتٍ، وَأُمَّهَاتُهُمْ شَتَّى، وَدِينُهُمْ وَاحِدٌ، فَلَيْسَ بَيْنَنَا نَبِيٌّ” (صحيح مسلم: ২৩৬৫).
অর্থাৎ: ভিন্ন ভিন্ন মায়ের সন্তান হওয়া সত্বেও সকল নবী-রাসূলগণ ভাইয়ের মত এবং তাদের ধর্ম এক। আমার এবং ঈসার (আ.) মধ্যে কোন নবী নেই। (সহীহ মুসলিম: ২৩৬৫) । সুতরাং ইহুদী-খৃষ্টানদের উচিৎ মোহাম্মদ (সা.) এবং কোরআনের প্রতি ঈমান আনার মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিমদেরকে স্বীকৃতি প্রদান করা। ইসলাম আমাদেরকে সকল নবী-রাসূল ও আসমানী কিতাবকে স্বীকৃতি প্রদান করতে শিক্ষা দেয়। যেমন: সূরা বাক্বারার একটি আয়াতে এসেছে:
﴿آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ﴾ [سورة البقرة: ২৮৫].
অর্থাৎ: “রাসূলুল্লাহ (সা.) সে বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, যা তার রবের পক্ষ থেকে তার উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুমিনরাও একই বিষয়ে ঈমান এনেছে। তারা সকলে ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কেতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলদের প্রতি। আমরা তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূলদের মধ্যে কোন ধরণের পার্থক্য করি না। আর মুমিনরা বলে: আমরা আল্লাহর নির্দেশ শুনেছি এবং মেনে নিয়েছি। হে আমাদের রব! আমরা আপনার কাছে ক্ষমা চাই এবং আমদেরকে একদিন আপনার কাছেই ফিরে যেতে হবে” (সূরাতু আল-বাক্বারা: ২৮৫) ।
(খ) উল্লেখিত অঙ্গীকারকে সুদৃঢ় করার জন্য প্রথমত আল্লাহ তায়ালা সকল নবী-রাসূল থেকে স্বীকৃতি গ্রহণ করেছেন এবং দ্বিতীয়ত প্রদত্ত স্বীকৃতির উপর তাদেরকে সাক্ষী রাখার পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা নিজেও সাক্ষী রয়েছেন। (মাফাতিহ আল-গাইব, রাযী: ৮/২৭৯) ।
২। ৮২নং আয়াতে নবী-রাসূলদের সাথে সংগঠিত চুক্তিকে তৃতীয় বারের মতো সুদৃঢ় করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে যারা উক্ত অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করবে তারা দীনের গন্ডি থেকে বেড়িয়ে গিয়ে কাফের হয়ে যাবে। (মাফাতিহ আল-গাইব, রাযী: ৮/২৭৯) ।
৩। ৮৩নং আয়াত থেকে দুইটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) অত্র আয়াতে চতুর্থ বারের মতো নবী-রাসূলদের সাথে সংগঠিত অঙ্গীকারকে সুদৃঢ় করা হয়েছে। যেখানে অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদেরকে তিরস্কারপূর্বক বলা হয়েছে, তারা কি আল্লাহর দীনকে বাদ দিয়ে অন্য কোন দীনকে তালাশ করছে, অথচ আসমান-যমীনের সবকিছু ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় তাঁর কাছে আত্মসমার্পণ করেছে। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩৪০) ।
(খ) আল্লাহ তায়ালার প্রতিটি সৃষ্টি তাঁর কাছে আত্মসমার্পণ করে থাকে। মানব ও জীন জাতি ছাড়া বাকী সকল সৃষ্টি জগত শতভাগ তাঁর কাছে আত্মসমার্পণ করে। আর মানব ও জীন জাতির মধ্যে যারা আল্লাহর অবাধ্য বা কাফির, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বিপদ-আপদ ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে এক মুহুর্তের জন্য হলেও আত্মসমার্পণ করতে বাধ্য করে থাকেন। যেমন: মহাসমূদ্রে জাহাজ যখন ঝড়ের কবলে পড়ে এবং মহাশুন্যে বিমান যখন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ইত্যাদি। (আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন)।
৫। (৮১-৮৩) নাম্বার আয়াতাবলীতে তিনটি ভঙ্গিতে মোহাম্মদ (সা.) এবং কোরআনকে অস্বীকারকারী ইহুদী-খৃষ্টানদের উচিৎ জবাব দেওয়া হয়েছে:
(ক) তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং কোরআনের সাথে যা করছে তা তাদের পূর্বপুরুষ নবী-রাসূলদের সাথে আল্লাহ প্রদত্ত চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক।
(খ) যারা উক্ত অঙ্গীকারকে লঙ্ঘন করবে, তারা কাফির।
(গ) তাদের এ চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

আয়াতাবলীর আমল:
১। সকল নবী-রাসূলদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। বিশেষ করে ইহুদী-খৃষ্টানদের উচিৎ মোহাম্মদ (সা.) সহ সকল নবী-রাসূলদেরকে সম্মান দেখানো এবং তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
২। ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ধর্মকে তালাশ না করা।

সূরা আলে-ইমরানের (৭৯-৮০) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: নবী-রাসূলদের প্রতি ইহুদী-খৃষ্টানদের অপবাদ ও তার জবাব।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِي مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ كُونُوا رَبَّانِيِّينَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُونَ (79) وَلَا يَأْمُرَكُمْ أَنْ تَتَّخِذُوا الْمَلَائِكَةَ وَالنَّبِيِّينَ أَرْبَابًا أَيَأْمُرُكُمْ بِالْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (80)﴾ [سورة آل عمران: 79-80].

আয়াতদ্বয়ের আলোচ্যবিষয়: নবী-রাসূলদের প্রতি ইহুদী-খৃষ্টানদের অপবাদ ও তার জবাব।

আয়াতদ্বয়ের সরল অনুবাদ:
৭৯। হে ইহুদী-খৃষ্টান সম্প্রদায়! জেনে রেখ কোন মানুষের জন্য সংগত নয় যে আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমাত এবং নবুয়াত দিবেন, অতঃপর সে মানুষকে বলবে: তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমার বান্দা হয়ে যাও, বরং সে বলবে: তোমরা আল্লাহ-ভক্ত হয়ে যাও, যেহেতু তোমরা শিক্ষা দিতে কিতাব এবং তা অধ্যায়ন করতে।
৮০। আর তোমাদেরকে নির্দেশ দিবেন না তোমরা ফেরেশতাদেরকে এবং নবীদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করো, তিনি কি তোমাদেরকে নির্দেশ দিবেন কুফরীর তোমাদের মুসলিম হয়ে যাওয়ার পরও।

আয়াতদ্বয়ের ভাবার্থ:
নাজরান থেকে আগত খৃষ্টান প্রতিনিধি দল, যারা ঈসাকে (আ.) ইলাহ হিসেবে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তায়ালা তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের জবাবে বলেন: একজন মানুষকে আল্লাহ তায়ালা নবী হিসেবে নির্বাচন করে তাকে কিতাব ও হিকমাত দিবেন আর তিনি চাইবেন সাধারণ মানুষ আল্লাহকে বাদ দিয়ে তার ইবাদত-বন্দেগী করবে, এটা কখনও সমিচীন নয়। আর এ রকম ঘটনা অতিতে কখনও ঘটেনি এবং ভবিষ্যতে কখনও ঘটবে না। সুতরাং হে খৃষ্টান প্রতিনিধি দল, তোমরা কিভাবে একজন নবী ঈসাকে (আ.) আল্লাহর স্থানে বসিয়ে তার ইবাদত-বন্দেগী করতে পারো!? বরং একজন নবী হিসেবে তিনি সর্বদা তোমাদেরকে কিতাব শিক্ষা এবং তা চর্চা করার মাধ্যমে আল্লাহ ভক্ত হতে বলেছেন।
আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে সাফ জানিয়ে দিলেন, তিনি কখনও কাউকে আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন ফেরেশতা অথবা পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের কারো ইবাদত-বন্দেগী করার নির্দেশ দেননি; কারণ সকল নবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য এবং মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর দিকে আহবান করার জন্য। তিনি কিভাবে তোমাদেরকে কুফরের নির্দেশ দিতে পারেন, অথচ তার দাওয়াতেই তো তোমরা এক আল্লাহর কাছে আত্মসমার্পন করে মুসলিম হয়েছো। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৩৭, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৬০, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৮) ।

আয়াতের বিরল শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿رَبَّانِيِّينَ﴾ “আল্লাহ ভক্ত”, আয়াতাংশে ‘আল্লাহ ভক্ত’ দ্বারা যিনি আল্লাহ সম্পর্কে জানেন এবং তাঁর অনুসরণ করেন, তাকে বুঝানো হয়েছে। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবা: ১/৯৬)।
﴿الْكُفْرِ﴾ “কুফরী করা”, আয়াতাংশ দ্বারা ইসলাম থেকে মুরতাদ হয়ে যাওয়াকে বুঝানো হয়েঝে। (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/৩৩৭) ।
﴿مِنْ دُونِ اللَّهِ﴾ “আল্লাহকে বাদ দিয়ে”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: আল্লাহর হক্বের সীমাকে অতিক্রম করে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা অথবা কাউকে শরীক করার নির্দেশ দেওয়া। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৯৬, তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৭৫) ।
(৭৯) আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: আবু রাফী আল-কুরাজী বলেন: নাজরান থেকে আগত ইহুদী-খৃষ্টানদের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে জমায়েত হলে তিনি তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করলে তারা জবাবে বললো: তুমি কি চাও আমরা তোমার ইবাদত-বন্দেগী করি যেমনিভাবে খৃষ্টানরা ঈসার (আ.) ইবাদত করে থাকে? তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: তোমাদের এ ভ্রান্ত কথা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা উনাশি নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করলেন।
আরেক বর্ণনায় এসেছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে এসে বললো: হে আল্লাহর রাসূল আমরা পরস্পরে যেভাবে সালাম বিনিময় করে থাকি, আপনার সাথেও তেমনি সালাম বিনিময় করি। এটা আপনার শানে বেমানান, আমরা কি আপনাকে সাজদা করতে পারি না? তিনি উত্তরে বললেন: না, কখনও সাজদা করবে না, বরং নবীদেরকে সম্মান করবে এবং সত্যকে বুঝবে অন্যকে জানিয়ে দিবে। জেনে রেখো, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সাজদা করা যায় না। (লুবাব আল-নুক‚ল, সুয়ূতী: ৬৫-৬৬) ।
পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে অত্র আয়াতদ্বয়ের সম্পর্ক:
আল্লাহ এবং তাঁর কিতাবের সাথে ইহুদী-খৃষ্টানদের মিথ্যাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে আর অত্র আয়াতদ্বয়ে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে তাদের মিথ্যাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৯৫) ।

আয়াতের শিক্ষা:
১। উনাশি নাম্বার আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে,
(ক) যাকে নবী হিসেবে নির্বাচন করা হয়, অথবা যে আলেমে রব্বানী হয় সে কখনও কাউকে নিজের আবিষ্কৃত আদর্শের দিকে আহবান করতে পারে না।
(খ) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাগ্যবান ও মহৎ সে ব্যক্তি, যে আল্লাহর ভয়ে নিজে দ্বীনী জ্ঞান শিখে সে অনুযায়ী আমল করে এবং অন্যকে সংসোধনের উদ্দেশ্যে তা শিক্ষা দেয়। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়েরী: ১/৩৩৮) ।
২। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন নবী-রাসূল কেমন হবেন? এবং তার দায়িত্ব কি হবে? সে বিষয়ে উল্লেখিত আয়াতদ্বয় সহ কোরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে যা জানা যায়, তা হলো:
(ক) একজন নবী সর্বদা মানব জাতিকে তাওহীদ বা একত্ববাদের দিকে আহবান করবে, যেমন একটি আয়াতে এসেছে, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
﴿وَما أَرْسَلْنا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لا إِلهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ﴾ [سورة الأنبياء: ২৫].
অর্থাৎ: “আমি আপনার পূর্বে যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছি সকলকে জানিয়ে দিয়েছি আমি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই, অতএব তোমরা আমার একত্ববাদের ঘোষণা দাও” (সূরা আল-আনবিয়া: ২৫) । অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে:
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾ [سورة النحل: ৩৬].
অর্থাৎ: “অবশ্যই আমি সকল উম্মতের কাছে এ নির্দেশ দিয়ে নবী-রাসূল পাঠিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দাও এবং তাগুতকে ত্যাগ করো” (সূরা আন-নাহল: ৩৬) ।
(খ) মানব জাতিকে দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা দিবে, যার ইঙ্গিত ৭৯ নং আয়াতের শেষাংশে রয়েছে। এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা কোরআনের সূরা বাক্বারা এর ১২৯, সূরা আলে-ইমরানের ১৬৪ এবং সূরা জুমুয়াহ এর ২ নাম্বার আয়াতে রাসূলুল্লাহকে (সা.) জাতির প্রশিক্ষক বলা হয়েছে।
(গ) মানব জাতিকে নিজের বানানো আদর্শের দিকে আহবান না করে, তাদের কাছে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাবে। ৭৯ নাম্বার আয়াতে এ কথার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে আরেকটি আয়াতে এসেছে:
﴿يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ﴾ [سورة المائدة: ৬৭].
অর্থাৎ: “হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ থেকে যা তোমার উপর অবতীর্ণ হয়েছে, তা মানব জাতির কাছে পৌঁছে দাও। যদি তা না করো, তাহলে তুমি আল্লাহর রিসালাতকে পৌঁছাতে পারনি। আর আল্লাহ তোমাকে মানবজাতি থেকে রক্ষা করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হেদায়েত দান করেন না” (সূরা মায়িদাহ: ৬৭) ।
(ঘ) মানব জাতিকে তো শিরকের দিকে আহবান করবেই না, বরং শিরকে লিপ্ত হলে তাদেরকে সংশোধন করবে, এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা সূরা বাক্বারা এর ১২৯, সূরা আলে-ইমরানের ১৬৪ এবং সূরা জুমুয়াহ এর ২ নাম্বার আয়াতে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
(ঙ) মানব জাতিকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে এবং জাহান্নামের ভয় দেখাবে, যেমন: এ বিষয়ে সূরা আনয়াম এর ৪৮ এবং সূরা কাহ্ফ এর ৫৬ নাম্বার আয়াতে এসেছে:
﴿وَمَا نُرْسِلُ الْمُرْسَلِينَ إِلَّا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ﴾ [سورة الأنعام: ৪৮، سورة الكهف: ৫৬].
অর্থাৎ: “আমি সকল নবী-রাসূদেরকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা এবং ভীতি প্রদর্শণকারী হিসেবে” (সূরা আনয়াম: ৪৮, সূরা কাহ্ফ: ৫৬)।
৩। আশি নাম্বার আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজের আবিষ্কৃত মতাদর্শের দিকে তো আহবান করা যাবেই না, বরং পছন্দসই বহুল প্রচলিত কোন আদর্শের দিকেও ডাকা যাবে না। কারণ, আয়াতে দেখা যায় একজন নবী কোন ফেরেশতা অথবা প্রশিদ্ধ নবী-রাসূলকে রব হিসেবে গ্রহণ করার দিকে আহবান করবে তা থেকেও নিষেধ করা হয়েছে। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

৪। আশি নাম্বার আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ইহুদী-খৃষ্টানদের অযৌক্তিক দাবীর জবাব দিয়ে বলেছেন যে, একজন মানুষ যখন কাউকে ইসলাম ও তাওহীদের দিকে আহবান করে এবং সে মুসলিম হয়ে যায়, এর পর তাকে পুনরায় ‍শিরকের দিকে দাওয়াত দিতে পারে না।

আয়াতদ্বয়ের আমল:
১। আল্লাহর পথের একজন দায়ী কখনও কাউকে শিরকের দিকে আহবান করবে না।
২। শরীয়াতের জ্ঞান অর্জন করা এবং তা জীবনে বাস্তবায়ন করা।
৩। আল্লাহ প্রদত্ব ইসলামী আদর্শকে বাদ দিয়ে সমাজে প্রচলিত মানব রচিত আদর্শকে গ্রহণ করা যাবে না।

সূরা আলে-ইমরানের ৭৮ নাম্বার আয়াতের তাফসীর, আয়াতের আলোচ্যবিষয়: আল্লাহর প্রতি  ইহুদীদের মিথ্যাচারিতা।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿وَإِنَّ مِنْهُمْ لَفَرِيقًا يَلْوُونَ أَلْسِنَتَهُمْ بِالْكِتَابِ لِتَحْسَبُوهُ مِنَ الْكِتَابِ وَمَا هُوَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَقُولُونَ هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَمَا هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ (78)﴾ [سورة آل عمران: 78]

আয়াতের আলোচ্যবিষয়: আল্লাহর প্রতি  ইহুদীদের মিথ্যাচারিতা।

আয়াতের সরল অনুবাদ:
৭৮। আর নিশ্চয় তাদের মধ্যে এমন একটি দল রয়েছে যারা কিতাব পাঠকালে তাদের জিহŸা বাঁকা করে, যেন তুমি তাকে কিতাবের অংশ মনে করো, কিন্তু তা কিতাবের অংশ নয়, আর তারা বলে: তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, কিন্তু তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি, আর তারা জেনে-বুঝে আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলে।

আয়াতের ভাবার্থ:
রাসূলুল্লাহর (সা.) সামসাময়িক মদীনার ইহুদী পন্ডিতদের তাওরাত বিকৃতি করার একটি অপকৌশলকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। তারা সাধারণ মানুষের সামনে তাদের মনগড়া বানোয়াট কথাগুলো এমনভাবে এনিয়ে বিনিয়ে জিহŸাকে আকিয়ে বাঁকিয়ে উপস্থাপন করে, যাতে তারা এগুলোকে তাওরাতের অংশ মনে করে। অনুরুপভাবে তারা দাবী করে এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, কিন্তু তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি। এভাবে তারা জেনে-বুঝে আল্লাহ তায়ালার সাথে মিথ্যাচারিতা করে থাকে। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৩৬, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৬০, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৮) ।

আয়াতের বিরল শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿الْكِتَابِ﴾ “কিতাব”, আয়াতটিতে তিনবার ‘কিতাব’ শব্দটি এসেছে, যার দ্বারা ‘তাওরাত’ কে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-নাসাফী: ১/২৬৮) ।
﴿لَفَرِيقًا﴾ “একটি দল”, আয়াতটিতে দল দ্বারা কাব বিন আশরাফ, মালিক ইবনু সাইফ এবং হুয়াই ইবনু আখতাব প্রমুখকে বুজানো হয়েছে। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/২৪) ।

(৭৮) আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: ইহুদীদের তৃতীয় এ গ্রæপটি আল্লাহর ব্যাপারে এমন বিষয়ে মিথ্যা অপবাদ দিতো, যে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। তারা ইসলামের ঘোর শত্রæ কা’ব বিন আশরাফের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে তাওরাতকে বিকৃতি করতো এবং এমন কিতাব রচনা করতো, যেখানে রাসূলুল্লাহর (সা.) গুণাবলী এবং তার আগমণের সুসংবাদ সম্বলিত আয়াতাবলীকে পরিবর্তন করা হত। এমনকি এগুলোকে বনী কুরাইজা গোত্র গ্রহণ করে তাদের নিজস্ব লিখিত কিতাবের সাথে মিশ্রন করে ফেলতো। (তাফসীর আল-কাশশাফ: ১/৩৩১) ।

আয়াতের শিক্ষা:
১। উল্লেখিত আয়াতে তাওরাত বিকৃতি করার অভিনব একটি পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নি¤েœর বিষয়গুলোকে তারা অনুসরণ করে:
(ক) তারা সাধারণ মানুষের সামনে মনগড়া বানোয়াট কথাগুলো এনিয়ে বিনিয়ে জিহŸাকে আকিয়ে বাঁকিয়ে উপস্থাপন করে।
(খ) এমন ভঙ্গিতে উপস্থাপন করে যাতে সাধারণ মানুষ এগুলোকে তাওরাতের অংশ মনে করে।
(গ) তাদের বানোয়াট কথাগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে বলে দাবী করে, কিন্তু তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি।
(ঘ) তারা জেনে-বুঝে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যাচার করে।
২। তাদের জিহŸা নেড়ে এনিয়ে বিনিয়ে কথা বলার কিছু উদাহরণ:
প্রথমত: তারা রাসূলুল্লাহকে (সা.) সালাম প্রদানের সময় “আসসালামু আলাইকুম” না বলে “আসসামু আলাইকুম” বলতো, যার অর্থ হলো: তোমার প্রতি মৃতু আসুক। যেমন একটি হাদীসে এসেছে:
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا: أَنَّ اليَهُودَ أَتَوُا النَّبِيَّ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-، فَقَالُوا: السَّامُ عَلَيْكَ، قَالَ: “وَعَلَيْكُمْ” فَقَالَتْ عَائِشَةُ: السَّامُ عَلَيْكُمْ، وَلَعَنَكُمُ اللَّهُ وَغَضِبَ عَلَيْكُمْ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-: “مَهْلًا يَا عَائِشَةُ، عَلَيْكِ بِالرِّفْقِ، وَإِيَّاكِ وَالعُنْفَ، أَوِ الفُحْشَ” قَالَتْ: أَوَلَمْ تَسْمَعْ مَا قَالُوا؟ قَالَ: “أَوَلَمْ تَسْمَعِي مَا قُلْتُ، رَدَدْتُ عَلَيْهِمْ، فَيُسْتَجَابُ لِي فِيهِمْ، وَلاَ يُسْتَجَابُ لَهُمْ فِيَّ” (متفق عليه).
অর্থাৎ: “আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: একবার একদল ইহুদী রাসূলুল্লাহর (সা.) নিকট এসে সালাম দিতে গিয়ে বললো: ‘আসসালামু আলাইকা’। তিনি বললেন: ‘ওয়ালাইকুম’। কিন্তু আয়েশা (রা.) বললেন: “আসসামু আলাইকুম ওয়া লায়ানাকুমুল্লাহ ওয়া গাযিবা আলাইকুম” (তোমরা ধ্বংস হও, আল্লাহ তোমাদের উপর লানাত করুন, আর তোমাদের উপর গযব অবতীর্ণ করুন)। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: হে আয়েশা তুমি থামো! তুমি ন¤্রতা অবলম্বন করো, আর তুমি কঠোরতা বর্জন করো। আয়েশা (রা.) বললেন: তারা কি বলেছে আপনি কি শুনেননি? তিনি বললেন: আমি যা বলেছি, তা কি তুমি শুননি? আমি তো তাদের কথাটা তাদের উপরই ফিরিয়ে দিলাম। কাজেই তাদের উপর আমার বদ্ দুয়া কবুল হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ব্যাপারে তাদের বদ দুয়া কবুল হবে না”। (বুখারী ও মুসলিম) ।
দ্বিতীয়ত: তারা রাসূলুল্লাহকে (সা.) দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে ‘রায়িনা’ সহজভাবে না বলে, ‘রায়েনা’ বলে, যার অর্থ দাড়ায় ‘আমাদের রাখাল’। এ সম্পর্কে কোরআনে এসেছে:
﴿مِنَ الَّذِينَ هادُوا يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَنْ مَواضِعِهِ وَيَقُولُونَ سَمِعْنا وَعَصَيْنا، وَاسْمَعْ غَيْرَ مُسْمَعٍ، وَراعِنا، لَيًّا بِأَلْسِنَتِهِمْ، وَطَعْناً فِي الدِّينِ، وَلَوْ أَنَّهُمْ قالُوا: سَمِعْنا وَأَطَعْنا، وَاسْمَعْ وَانْظُرْنا، لَكانَ خَيْراً لَهُمْ وَأَقْوَمَ﴾ [سورة النساء: ৪৬].
অর্থাৎ: “ইহুদীদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহর কথাকে তার জায়গা থেকে বিকৃতি করতে চায়, তারা বলে: আমরা শুনলাম এবং অবাধ্য হলাম, আর শোন না শোনার মতো, আর তাদের জিহŸা বাঁকা করে, দ্বীনের প্রতি আঘাত করে বলে ‘ওয়া রায়িনা’ । আর যদি তারা বলতো: শুনলাম এবং মানলাম, শুনুন এবং আমাদের প্রতি খেয়াল করুন, তাহলে তাদের জন্য কল্যাণ হতো” (সূরা নিসা: ৪৬)।
৩। আবু বকর আল-জাযায়িরী (র.) অত্র আয়াতের তিনটি শিক্ষা উল্লেখ করেছেন:
(ক) ধর্ম ও জ্ঞানের নামে সাধারণ ইহুদীদেরকে বিভ্রান্ত করতে ইহুদী পন্ডিতদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া।
(খ) জেনে-বুঝে আল্লাহর সাথে মিথ্যাচারের দুঃসাহস দেখানো, যা বড় অন্যায়।
(গ) ইহুদীদের বিভ্রান্তিকর আচরণ এবং পার্থিব উদ্দেশ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কলুষিত কথা বলার বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে সতর্ক করা। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩৩৬) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) ইহুদী-খৃষ্টানদের দ্বারা তাওরাত এবং ইনজীল বিকৃত হয়েছে, এ কথা বিশ্বাস করা।
(খ) ইহুদী-খৃষ্টানদের সকল ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক থাকা।

সূরা আলে-ইমরানের (৭৫-৭৭) আয়াতাবলীর তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: আমানত ফেরত প্রদান ও অঙ্গীকার পূর্ণ করার গুরুত্ব এবং এ বিষয়ে ইহুদী-খৃষ্টানের চরিত্র।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿وَمِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مَنْ إِنْ تَأْمَنْهُ بِقِنْطَارٍ يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَنْ إِنْ تَأْمَنْهُ بِدِينَارٍ لَا يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ إِلَّا مَا دُمْتَ عَلَيْهِ قَائِمًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الْأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ (75) بَلَى مَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ وَاتَّقَى فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ (76) إِنَّ الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَئِكَ لَا خَلَاقَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (77)﴾ [سورة آل عمران: 75-77]

 

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়:
আমানত ফেরত প্রদান ও অঙ্গীকার পূর্ণ করার গুরুত্ব এবং এ বিষয়ে ইহুদী-খৃষ্টানের চরিত্র।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৭৫। আর ইহুদী-খৃষ্টানদের মধ্যে কিছু লোক আছে, যাদের কাছে যদি অঢেল সম্পদ আমানত রাখো, তবুও সে তা তোমার নিকট আদায় করে দিবে; তাদের মধ্যে কিছু লোক আছে যাদের কাছে যদি আমানত রাখো একটি দীনার, তবে তার পিছনে লেগে না থাকলে সে তা তোমাকে আদায় করবে না; এটি এ কারণে যে, তারা বলে থাকে: আমাদের উপর উম্মীদের ব্যাপারে কোন পাপ নেই; আর তারা আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলে, অথচ তারা জানে।
৭৬। হ্যাঁ, যে তার প্রতিশ্রæতি পূর্ণ করে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ মোত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন ।
৭৭। নিশ্চয় যারা আল্লাহর অঙ্গীকার এবং তাদের শপথের বিনিময়ে স্বল্প মূল্য ক্রয় করে, পরকালে তাদের কোন অংশ নেই। আর আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
আর আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ইহুদীদের একটি দল এতই আমানতদার যে, তাদের কাছে কেউ যদি অঢেল সম্পত্তিও আমানত রাখে, তাহলে তারা তা মালিকের কাছে অনায়াসে ফেরত প্রদান করে। যেমন: আব্দুল্লাহ ইবনু সালামের কাছে কোরাইশ বংশের এক ব্যক্তি এক হাজার দুই শত আওকিয়া আমানত রাখলে তিনি তা যথসময়ে ফেরত দিয়েছিলেন। অপরদিকে তাদের মধ্যে আরেকটি দল রয়েছে যাদের কাছে কেউ সামান্য সম্পদ আমানত রাখলেও তারা তা মালিকের কাছে ফেরত দিতে গড়িমসি করে থাকে। এ আমানত ফেরত পাওয়ার জন্য মালিকের পক্ষ থেকে বাধ্য করা না হলে তারা তা ফেরত না দিয়ে বলে থাকে: মুশরিকদের সম্পদ ফেরত দেওয়া জরুরী না, তাওরাত গ্রন্থে তা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। যেমন: কা’ব বিন আশরাফের কাছে কোরাইশ বংশের এক ব্যক্তি একটি মাত্র দীনার আমানত রাখলে সে তা ফেরত দিতে অস্বীকার করেছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ খেয়ানতী মনোভাবের জবাবে বলেন: তাদের জন্য কারো আমানতের খেয়ানত করাকে হালাল করা হয়নি, বরং তারা জেনে বুঝে মিথ্যাচার করছে। বরং তাওরাতের বিধান হলো: যে কেউ তাদের কাছে কোন কিছু আমানত রাখলে তার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া তাদের প্রতি ওয়াজিব। যারা এ বিধান মেনে চলবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ভালোবাসবেন।
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা যারা তাঁর সাথে গৃহীত অঙ্গীকারের ভঙ্গকারী এবং আমানতের খেয়ানতকারীর জন্য পাঁচটি শাস্তি বর্ণনা করেছেন:
(ক) তাদের জন্য আখেরাতে কোন অংশ থাকবে না।
(খ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে কথা বলবেন না।
(গ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের দিকে তাকাবেন না।
(ঘ) আখেরাতে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরিচ্ছন্ন করবেন না।
(ঙ) তাদের জন্য আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩৪-৩৩৫, তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬৬-২৬৮, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৭-৯৮) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿بِقِنْطَارٍ﴾ “অঢেল সম্পদ”, ‘ক্বিনতার’ শব্দটি আরবী, যা অনেক পরিমাণ বুঝানোর জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। (তাফসীর সা’দী: ১/১৩৫) ।
﴿بِدِينَارٍ﴾ “সামান্য সম্পদ”, ‘দীনার’ শব্দটি দ্বারা ক্ষুদ্রাংশের প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৮৮) ।
﴿الْأُمِّيِّينَ﴾ “নিরক্ষর”, এখানে আয়াতাংশ দ্বারা আরব অথবা কোরাইশদেরকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৮৮) ।
﴿سَبِيلٌ﴾ “পথ”, তবে এখানে আয়াতাংশ দ্বারা ‘গুনাহ’ কে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৮৮) ।

(৭৭) আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র.) বর্ণনা করেছেন যে, আশয়াচ (রা.) বলেন: আমার এবং এক ইহুদী ব্যক্তির যৌথ এক টুকরা ভ‚মি ছিল। আমি আমার অংশ চাইলে সে তা দিতে অস্বীকার করে। অতঃপর আমি বিষয়টিকে রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে পেশ করলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি ভ‚মির মালিক হওয়ার স্বপক্ষে কোন দলীল আছে? আমি উত্তরে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমার কাছে কোন প্রমাণপত্র নেই। তখন তিনি ইহুদী ব্যক্তিকে যমীনের মালিক হওয়া মর্মে শপথ করতে বললেন। তখন আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল (সা.), তা হলে তো সে মিথ্যা শপথ করে ভ‚মির মালিক হয়ে যাবে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াত অবতীর্ণ করে ইহুদী ব্যক্তিকে সতর্ক করে দিলেন যে, কোন অবস্থাতেই মিথ্যা শপথ করা যাবে না।
ইমাম বুখারী (র.) বর্ণনা করেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আবি আওফা (রা.) বলেন: এক ইহুদী বিক্রেতা মুসলমান ক্রেতাদেরকে ধোকা দেওয়ার জন্য পণ্যের গুণাগুণ অতিরঞ্জিতভাবে বর্ণনা করতো। আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াত অবতীর্ণ করে তাকে সতর্ক করে দিলেন।
ইবনু হাযার আসকালানী (র.) বলেন: উল্লেখিত দুই হাদীসের মধ্যে কোন অসামঞ্জস্যতা নেই, বরং এখানে আয়াতটি অবতীর্ণের দুইটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম তবারী (র.) ইকরামাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আয়াতটি হুয়াই ইবনু আখতাব, কা’ব বিন আশরাফ এবং অন্যান্য ইহুদী সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা তাওরাতের বিধানকে গোপন রেখে মনগড়া বানানো বিধানকে সাধারণ মানুষের কাছে উল্লেখ করে আল্লাহর শপথ করে বলতো এ বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। (লুবাব আন-নুকুল, সুয়ূতী: ৬৫) ।

পূর্ববর্তী আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে আক্বীদা সম্পৃক্ত বিষয়ে ইহুদী-খৃষ্টানদের নিজেদের অবস্থান এবং মুমিনদেরকে ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাস থেকে বিপদগামী করার ব্যাপারে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে। আর উল্লেখিত আয়াতে মুসলমানদেরকে অর্থনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্য ইহুদী-খৃষ্টানদের একটি দলের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। (আল-মোন্তাখাব: ১/৯৭) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। পঁচাত্তর নাম্বার আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, ইহুদী-খৃষ্টানদের মধ্যে আমানতদার এবং খেয়ানতকারী, দুই শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। তবে এরা কারা? এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের থেকে তিনটি মত পাওয়া যায়:
(ক) ইহুদীদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা আমানতদার এবং যারা ইহুদী ধর্মে রয়ে গেছে, তারা খেয়ানতকারী।
(খ) খৃষ্টানরা আমানতদার এবং ইহুদীরা খেয়ানতকারী।
(খ) আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম আমানতদার এবং ফিনহাস ইবনু আজুরা খেয়ানতকারী। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, আল-রাযী: ৮/২৬২) ।
২। পচাত্তর নাম্বার আয়াতের তাফসীরে ইমাম তবারী (র.) বলেন: ইহুদী-খৃষ্টানদের কাছে আমানত রাখা হলে তারা স্বাভাবিক ভাবে তা ফেরত দিতো, কিন্তু আমনতকারী যদি ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়ে যেত, তাহলে তার কাছে আমনত ফেরত দিতে অস্বীকার করে বলতো: তাদের আমানত ফেরত না দিলে গুনাহ হবে না। (তাফসীর আল-তবারী: ৬/৫২৩)।
৩। (৭৬-৭৭) নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায়, যারা আল্লাহ তায়ালার সাথে প্রদত্ত ওয়াদা পূর্ণ করবে অর্থাৎ: আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধকে মান্য করবে ও রাসূলুল্লাহকে (সা.) রাসূল হিসেবে মেনে নিবে এবং মানুষের সাথে কৃত অঙ্গীকারকে পূর্ণ করবে তাদের পুরস্কার হলো: আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা। অপরদিকে যারা অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করবে, তাদের জন্য পাঁচটি শাস্তি রয়েছে:
(ক) তাদের জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই।
(খ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে কথা বলবেন না।
(গ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের দিকে তাকাবেন না।
(ঘ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পবিত্র করবেন না।
(ঙ) তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) ইহুদী-খৃষ্টানদের সবাইকে এক ওজনে পরিমাপ না করা।
(খ) আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে মান্য করা।
(গ) মানুষের সাথে প্রদত্ত অঙ্গীকারকে পূর্ণ করা।

সূরা আলে-ইমরানের (৭২-৭৪) আয়াতাবলীর তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: আহলে কিতাব কর্তৃক দ্বীনকে নিয়ে তামাশা ও আল্লাহর জবাব।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿وَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ آمِنُوا بِالَّذِي أُنْزِلَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَجْهَ النَّهَارِ وَاكْفُرُوا آخِرَهُ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ (72) وَلَا تُؤْمِنُوا إِلَّا لِمَنْ تَبِعَ دِينَكُمْ قُلْ إِنَّ الْهُدَى هُدَى اللَّهِ أَنْ يُؤْتَى أَحَدٌ مِثْلَ مَا أُوتِيتُمْ أَوْ يُحَاجُّوكُمْ عِنْدَ رَبِّكُمْ قُلْ إِنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (73) يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ (74)﴾ [سورة آل عمران: 72-74].

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: আহলে কিতাব কর্তৃক দ্বীনকে নিয়ে তামাশা ও আল্লাহর জবাব।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৭২। আহলে কিতাবের আরেকটি দল বলে: তোমরা দিনের প্রথম ভাগে তার প্রতি ঈমান গ্রহণ করো, যা অবতীর্ণ করা হয়েছে মুমিনদের উপর; এবং দিনের শেষ ভাগে তার প্রতি কুফরী করো, হয়তো তারা ফিরে আসবে।
৭৩। আর তোমরা কেবল তাদেরকে বিশ্বাস করো, যারা তোমাদের দ্বীনের অনুসরণ করে; বলো: নিশ্চয় আল্লাহর হেদায়েত হলো একমাত্র হেদায়েত; (তোমরা এ কথাও বিশ্বাস করো না যে) দেওয়া হবে কাউকে তার অনুরুপ যা তোমাদেরকে (ইতঃপূর্বে) দেওয়া হয়েছে, অথবা তারা তোমাদের সাথে বিতর্ক করবে তোমাদের রবের নিকট; বলো: নিশ্চয় সকল অনুগ্রহ আল্লাহর হাতে, তা দান করেন তিনি যাকে চান; আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
৭৪। তাঁর মহমতের সাথে যাকে ইচ্ছা খাস করে নেন; আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতে ইহুদীদের তৃতীয় আরেকটি চক্রান্ত হলো- তারা নিজেদের ভিতর আপোস করে নিয়েছিল যে, তারা সকালে মুমিন হয়ে আবার সন্ধায় কাফির হয়ে যাবে। এ থেকে মুসলিমদের অন্তরেও নিজেদের ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে যাবে। তারা ভাববে এরা ইসলাম গ্রহণ করার পর পুনরায় তাদের ধর্মে ফিরে গেছে, অতএব হতে পারে ইসলামে এমন বহু দোষ-ত্রæটি রয়েছে, যা তারা জানতে পেরে এ ধর্ম ত্যাগ করেছে।
তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে বলতো: তোমরা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কোন ধর্মাবলম্ভীদেরকে বিশ্বাস করো না। আল্লাহ তায়ালা তাদের জবাবে বলেছেন: তোমাদের ছলনা ও প্রতারণায় কিছু হবে না; কারণ হেদায়েত তো আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে হেদায়েত দিবেন তোমাদের প্রতারণা তাকে হেদায়েত থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না।
তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে আরো বলতো: তোমরা এ কথা মনে কর না যেই দ্বীন-শরীয়ত এবং জ্ঞান-মর্যাদা তোমরা লাভ করেছো, তা অন্য কেউ লাভ করতে পারে; অথবা তোমরা ছাড়া অন্য কেউ সত্যের উপর থাকতে পারে, যা দিয়ে আল্লাহর সামনে দলীল পেশ করে তোমাদেরকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ভ্রান্ত কথার জবাবে বলেন: তাদের জেনে রাখা উচিৎ দ্বীন ও শরীয়ত হলো আল্লাহর অনুগ্রহ। এটা কারো উত্তরাধিকার সূত্রে লদ্ধ জিনিস নয়, বরং তিনি তাঁর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা দান করেন, আর এ অনুগ্রহ কাকে দেওয়া উচিৎ, তাও তিনি ভালো জানেন। তিনি হলেন মহা অনুগ্রহশীল। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩২, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৭) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿وَجْهَ النَّهَارِ﴾ “দিনের সম্মুখভাগ”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: সকাল। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবা: ৯৫/ তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৭২) ।
﴿آخِرَهُ﴾ “দিনের শেষের ভাগ”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- বিকাল। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবা: ৯৫/ তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৭২) ।

(৭১-৭৩) আয়াতদ্বয় অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনু সাইফ, আদী ইবনু যায়েদ এবং হারিস ইবনু আউফ নামক ইহুদীরা একে অপরকে বলতো: এসো আমরা সকালে মোহাম্মদের উপর অবতীর্ণ হওয়া কিতাবের প্রতি ঈমান আনি এবং বিকালে তা ত্যাগ করি। এতে তাদের দ্বীন সম্পর্কে তাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হবে। ফলে, এক পর্যায় তারা তাদের দ্বীন থেকে ফিরে আসবে। তাদের এ চক্রান্তের জবাবে আল্লাহ তায়ালা (৭১-৭৩) নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করেন। (লুবাব আল-নুক‚ল ফি আসাবাব আল-নুযূল, সুয়ূতী: ৫১) ।
পূর্ববর্তী আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে হক্ব থেকে বিমুখ হওয়ার ব্যাপারে ইহুদী-খৃষ্টানদের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে, আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে মুমিনদেরকে সত্য পথ থেকে বিপদগামী করার ব্যাপারে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। (৭২-৭৩) আয়াতদ্বয়ে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইহুদী-খৃষ্টানদের তিনটি চক্রান্ত উল্লেখ করা হয়েছে:
(ক) নিজেদেরকে ঈমানদার দাবী করে মুমিনদেরকে ধোকা দেওয়া, তারা নিজেদের ভিতর আপোস করে নিয়েছিল যে, তারা সকালে মুমিন হয়ে আবার সন্ধায় কাফির হয়ে যাবে। এ থেকে মুসলিমদের অন্তরেও নিজেদের ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে যাবে। ফলে, তারা ভাববে এরা ইসলাম গ্রহণ করার পর পুনরায় তাদের ধর্মে ফিরে গেছে, অতএব হতে পারে ইসলামে এমন বহু দোষ-ত্রæটি রয়েছে, যা তারা জানতে পেরে এ ধর্ম ত্যাগ করেছে।
(খ) নিজেদেরকে ছাড়া অন্য ধর্মের কোন অনুসারীকে বিশ্বাস না করা, তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে বলতো: তোমরা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কোন ধর্মাবলম্ভীদেরকে বিশ্বাস করো না। আল্লাহ তায়ালা তাদের জবাবে বলেছেন: তোমাদের ছলনা ও প্রতারণায় কিছু হবে না; কারণ হেদায়েত তো আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে হেদায়েত দিবেন তোমাদের প্রতারণা তাকে হেদায়েত থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না।
(গ) কেবল নিজেদেরকেই হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে দাবী করা, তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে আরো বলতো: তোমরা এ কথা মনে কর না যেই দ্বীন-শরীয়ত এবং জ্ঞান-মর্যাদা তোমরা লাভ করেছো, তা অন্য কেউ লাভ করতে পারে; অথবা তোমরা ছাড়া অন্য কেউ সত্যের উপর থাকতে পারে, যা দিয়ে আল্লাহর সামনে দলীল পেশ করে তোমাদেরকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ভ্রান্ত কথার জবাবে বলেন: তাদের জেনে রাখা উচিৎ দ্বীন ও শরীয়ত হলো আল্লাহর অনুগ্রহ। এটা কারো উত্তরাধিকার সূত্রে লদ্ধ জিনিস নয়, বরং তিনি তাঁর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা দান করেন, আর এ অনুগ্রহ কাকে দেওয়া উচিৎ, তাও তিনি ভালো জানেন। তিনি হলেন মহা অনুগ্রহশীল। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০-২৬১) ।
২। উল্লেখিত আয়াতাবলীর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের ধোঁকাবাজি, একগুঁয়েমি এবং অন্যকে বিভ্রান্ত করার হীনতম চরিত্রের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৩৩) ।
৩। রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইহুদীরা মুসলমানদের কোন ধর্মীয় বিষয়কে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। যুগ যুগ ধরে তাদের বংশীয় চরিত্রকে তারা ধারণ করে আসছে। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৩৩) ।
৪। (৭৩-৭৪) আয়াতদ্বয় থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, হেদায়েত এবং কারো উপর দয়ার একক মালিক আল্লাহ। তিনি যাকে ইচ্ছা এ দুইটি নেয়ামতের জন্য নির্ধারণ করে থাকেন। (আল্লাহই ভালো জানেন)

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) অন্যকে বিভ্রান্ত অথবা কোন ধরণের ক্ষতি করার জন্য চক্রান্ত না করা।
(খ) নিজের মত অথবা দলকে হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে মর্মে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা ইহুদীদের চরিত্র।
(গ) হেদায়েত কেবল আল্লাহ তায়ালার কাছে কামনা করা।

 

সূরা আলে-ইমরানের (৬৯-৭১) আয়াতাবলীর তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: কিছু আহলে কিতাবের দ্বারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা এবং আল্লাহ কর্তৃক জবাব।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿وَدَّتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يُضِلُّونَكُمْ وَمَا يُضِلُّونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ (69) يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأَنْتُمْ تَشْهَدُونَ (70) يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَلْبِسُونَ الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ (71)﴾ [سورة آل عمران: 69-71].

 

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়:

কিছু আহলে কিতাবের দ্বারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা এবং আল্লাহ কর্তৃক জবাব।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৬৯। আহলে কিতাবের মধ্য থেকে একটি দল কামনা করে, যদি তারা তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারতো! কিন্তু তারা বিভ্রান্ত করছে কেবল নিজেদেরকেই, অথচ তারা অনুভব করে না।
৭০। হে আহলে কিতাব! আল্লাহর আয়াতাবলীকে কেন অস্বীকার করছো? অথচ তোমরাই তার সাক্ষ্য দিচ্ছো।
৭১। হে আহলে কিতাব! তোমরা কেন সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করছো এবং সত্যকে গোপন করছো, অথচ তোমরা অবগত আছো।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
ইহুদী-খৃষ্টানদের একটি দল সর্বদা ইসলামের মৌলিক বিষয়ে সন্দেহ ঢুকানোর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিপথগামী করতে চায়। আল্লাহ তায়ালা তিনটি পদ্ধতিতে তাদের এ হীন আচরণের জবাব দিয়েছেন:
প্রথমত: ঘৃণ্য আচরণের পরিণতি বর্ণনা করার মাধ্যমে, এ কাজের মাধ্যমে তারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার পরিবর্তে নিজেদেরকেই পথভ্রষ্ট করছে। তারা বুঝতে পারছে না যে তাদের এ অপকর্ম মুসলমানদের তো কোন ক্ষতি করতে পারছেই না, বরং এর জন্য তারা শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত: তাদের চিরাচরিত ঘৃণ্য স্বভাব বর্ণনার মাধ্যমে, এ ক্ষেত্রে তারা দুইটি কাজ করতো:
(ক) তাওরাত-ইনজীলের যে সকল আয়াতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে সুসংবাদ এসেছে, তারা কেন সে সকল আয়াতকে অস্বীকার করে? অথচ তারা জানে রাসূলুল্লাহর (সা.) আগমণের সুসংবাদ সত্য।
(খ) তারা কেন তাদের গ্রন্থে বিদ্যমান মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে বিভিন্ন গুণাবলীকে তাদের বিকৃত মতবাদের সাথে মিশ্রিত করে ফেলেছে এবং মোহাম্মদ (সা.) এর গুণাবলীকে গোপন রাখার চেষ্টা করছে। অথচ তারা এর হাক্বীকত সম্পর্কে জানেন। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩০, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৮-৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৬) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿طَائِفَةٌ﴾ “একটি দল”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ইহুদী এবং খৃষ্টানদের মধ্যে যারা আহবার-রুহবান বা ওলামা রয়েছে। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৬৯) ।
﴿وَمَا يُضِلُّونَ﴾ “তারা বিভ্রান্ত করে কেবল নিজেদেরকে”, আয়াতাংশে ইদলাল আরবী শব্দ যার অর্থ হলো: বিভ্রান্ত করা বা পথভ্রষ্ট করা। এর আরেকটি অর্থ হলো: ধ্বংস করা। ইমাম তবারী (র.) বলেন: অত্র আয়াতে শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে এসেছে। (তাফসীর আল-তাবারী: ৬/৫০০) ।
﴿بِآيَاتِ اللَّهِ﴾ “আল্লাহর আয়াতাবলীর প্রতি”, আয়াতাংশে আল্লাহর আয়াতাবলী দ্বারা ঐ সকল আয়াতাবলীকে বুঝানো হয়েছে যে সকল আয়াতে রাসূলুল্লাহর (সা.) আগমণের সুসংবাদ এবং তার গুণাবলী নিয়ে কথা বলা হয়েছে। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/২২) ।
﴿الْحَقّ﴾ “সত্য”, আয়াতের দুই জায়গাতেই ‘সত্য’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: রাসূলুল্লাহর (সা.) গুণাবলী, যা তাওরাতে এসেছে। (তাফসীর ইবনু কাছীর: ২/৫৯) ।
﴿بِالْبَاطِلِ﴾ “বাতিলের সাথে”, আয়াতাংশে বাতিল দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: তাহরীফ বা বিকৃতিকরণ। যেহেতু তারা রাসূলুল্লাহর গুণাবলী ও সুসংবাদ সম্বলিত আয়াতাবলীকে বিকৃত করেছিল। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/২৩) ।

(৬৯) নাম্বার আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
মুয়াজ ইবনু জাবাল, আম্মার ইবনু ইয়সির এবং হুযাইফা ইবনুল ইয়ামানকে যখন ইহুদীরা তাদের ধর্মের দিকে আহবান করেছিল, তখন তাদের সম্পর্কে উনসত্তর নাম্বার আয়াতঅবতীর্ণ হয়েছে। (আসবাব আল-নুযূল, ওয়াহেদী: ১১১) ।

পূর্ববর্তী আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে হক্ব থেকে বিমুখ হওয়ার ব্যাপারে তাদের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে, আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে মুমিনদেরকে সত্য পথ থেকে বিপদগামী করার ব্যাপারে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। উনসত্তর নাম্বার আয়াতে তিনটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ইহুদী-খৃষ্টানরা সর্বদা হিংসার বশবর্তী হয়ে মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করতে চায়। যেমন: এ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার একটি আয়াতে এসেছে:
﴿وَدَّ كَثِيرٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتابِ لَوْ يَرُدُّونَكُمْ مِنْ بَعْدِ إِيمانِكُمْ كُفَّاراً حَسَداً مِنْ عِنْدِ أنْفُسِهِمْ﴾ [سورة البقرة: ১০৯].
অর্থাৎ: “অনেক ইহুদী-খৃষ্টানরা তোমাদের ঈমান গ্রহণের পরেও হিংসার বশবর্তী হয়ে পুণরায় আবার তোমাদেরকে কুফরীর দিকে ফিরিয়ে আনতে চায়” (সূরা বাক্বারা: ১০৯) ।
(খ) ইহুদী-খৃষ্টানরা শত চেষ্টা করেও মুসলমানদেরকে গোমরাহ করতে পারে নাই, বরং নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০) ।
(গ) অন্যকে ক্ষতি করার জন্য গর্ত খনন করলে, অজান্তে সে নিজেই সেই গর্তে পতিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/৩৩০) ।
২। উল্লেখিত তিনটি আয়াতে যারা ইসলামের মৌলিক বিষয়ে সন্দেহ ঢুকানোর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিপথগামী করতে চায়, তিনটি পদ্ধতিতে আল্লাহ তায়ালা তাদের এ হীন আচরণের জবাব দিয়েছেন:
প্রথমত: ঘৃণ্য আচরণের পরিণতি বর্ণনা করার মাধ্যমে, এ কাজের মাধ্যমে তারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার পরিবর্তে নিজেদেরকেই পথভ্রষ্ট করছে।
দ্বিতীয়ত: তাদের চিরাচরিত ঘৃণ্য স্বভাব বর্ণনা পূর্বক তিরস্কার করার মাধ্যমে, এ ক্ষেত্রে তারা দুইটি কাজ করে থাকে:
(ক) তাওরাত-ইনজীলের যে সকল আয়াতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে সুসংবাদ এসেছে, তারা জেনে বুঝে সে সকল আয়াতকে কেন অস্বীকার করে থাকে?
(খ) তারা তাদের গ্রন্থে বিদ্যমান মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে বিভিন্ন গুণাবলীকে তাদের বিকৃত মতবাদের সাথে কেন মিশ্রিত করে ফেলে এবং তা গোপন রাখার চেষ্টা করে কেন? (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩০, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৮-৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৬) । সুতরাং মুসলমানগণ যেন তাদের বিভ্রান্তিমূলক আচরণে বিব্রতবোধ না করে।
৩। সত্তর নাম্বার আয়াতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নবী হওয়ার সত্যতার প্রমাণ রয়েছে; কারণ তাওরাতে তার আগমণের সুসংবাদ থাকার বিষয়ে তিনি সংবাদ দিয়েছেন। অথচ তিনি লেখাপড়া জানতেন না। আল্লাহ তায়ালা তাকে এ বিষয়ে সংবাদ না দিলে তিনি তা জানতে পারতেন না। সুতরাং বুঝা যায় তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন নবী ও রাসূল। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২৫৬) ।
৪। একাত্তর নাম্বার আয়াতে ইহুদী আলেমদের সাধারণ মানুষের সাথে তামাশাপূর্বক তাওরাতের বাণীকে গোপন রাখার মাধ্যমে তা বিকৃতি করার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তারা যতগুলো পদ্ধতি অনুসরণ করে তাওরাতকে বিকৃতি করেছিল তার অন্যতম হলো: (ক) তাওরাতের বিধানকে তাদের মনগড়া ও সুবিধানুযায়ী কিছু বিধানের সাথে মিশ্রণ করা এবং (খ) তাওরাতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) আগমণ সম্পর্কিত কথাগুলো গোপন রাখা।
একজন আলেমের দায়িত্ব হলো আল্লাহ তায়ালা আসমানী কিতাবে যা বলেছেন তা কোন ধরণের পরিবর্তন-পরিবর্ধন, মিশ্রন এবং গোপন করা ছাড়াই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, যাতে তারা বাতিলকে সত্য থেকে, হারামকে হালাল থেকে এবং অপবিত্রতাকে পবিত্রতা থেকে পার্থক্য করতে পারে। অন্যথায় মানুষের বিশাল অংশ আল্লাহ প্রদত্ব অহীর জ্ঞান তথা হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হবে। (তাফসীর সা’দী: ১৩৪) ।
৫। ইহুদী-খৃষ্টানরা দুইটি কাজ করতো এবং এখনও করে: (ক) তারা মোহাম্মদকে (সা.) নবী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং (খ) তারা মোহাম্মদের (সা.) নবী হওয়া ও ইসলামের মৌলিক বিষয়ে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য তাতে সন্দেহ প্রবেশ করিয়ে থাকে। সত্তর নাম্বার আয়াতে তাদের প্রথম স্বভাব থেকে এবং একাত্তর নাম্বার আয়াতে দ্বিতীয় স্বভাব থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২৫৬) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) অন্যকে বিভ্রান্ত অথবা কোন ধরণের ক্ষতি না করা।
(খ) রাসূলুল্লাহকে (সা.) নবী ও রাসূল হিসেবে মেনে নেওয়া।
(গ) আলেম সর্বদা কোরআন-সুন্নাহের বাণী কোন ধরণের অপব্যাখ্যা ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিবে।

সূরা আলে-ইমরানের (৬৪-৬৮) আয়াতাবলীর তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: একাত্ববাদের ডাক।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ (64) يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تُحَاجُّونَ فِي إِبْرَاهِيمَ وَمَا أُنْزِلَتِ التَّوْرَاةُ وَالْإِنْجِيلُ إِلَّا مِنْ بَعْدِهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (65) هَا أَنْتُمْ هَؤُلَاءِ حَاجَجْتُمْ فِيمَا لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ فَلِمَ تُحَاجُّونَ فِيمَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (66) مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ (67) إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِإِبْرَاهِيمَ لَلَّذِينَ اتَّبَعُوهُ وَهَذَا النَّبِيُّ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُؤْمِنِينَ (68)﴾ [سورة آل عمران: 64-68].

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: একাত্ববাদের ডাক।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ ও শব্দার্থ:
৬৪ হে আল্লাহর রাসূল! তুমি বলো: হে আহলে কিতাব! এসো এমন কালেমার দিকে যা আমাদের মধ্যে এবং তোমাদের মধ্যে সমান; (তা এই যে) আমরা ইবাদত করব না আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো, শরীক করবো না তাঁর সাথে কাউকে এবং আমাদের কেউ আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করবো না। আর যদি তারা বিমুখ হয়, তাহলে তোমরা বলো: তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।
৬৫। হে আহলে কিতাব! কেন বিতর্ক করছো ইব্রাহীমকে নিয়ে? অথচ তাওরাত ও ইনজীল অবতীর্ণ হয়েছিলো তার আগমণের পরে, তোমরা কি বুঝবে না?
৬৬। সাবধান! তোমরা তো সে সব লোক যারা বিতর্ক করছো এমন বিষয়ে, যে সম্পর্কে তোমাদের জ্ঞান রয়েছে; তাহলে তোমরা কেন বিতর্ক করছো এমন বিষয়ে, যার জ্ঞান তোমাদের নেই; আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জানো না।
৬৭। ইব্রাহীম ইহুদীও ছিলো না এবং খৃষ্টানও ছিলো না, বরং সে ছিলো একনিষ্ঠ মুসলিম, আর সে ছিলো না মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত।
৬৮। নিশ্চয় ইব্রাহীমের সবচেয়ে নিকটবর্তী মানুষ হলো যারা তার অনুসরণ করেছে এবং এই নবীর ও মুমিনগণ; আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
আল্লাহ তায়ালা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) মাধ্যমে আহলে কিতাবকে তাওহীদের কালেমার দিকে আহবান করেছেন, যার অনুসরণ করা মুসলিম, খৃষ্টান ও ইহুদী নির্বিশেষে সকলের জন্য কর্তব্য। আর তাওহীদের কালেমা হলো: (ক) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা, (খ) তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা এবং (গ) নিজেদের মধ্যে কাউকে বিভিন্ন উপাদিতে ভ‚ষিত করে রবের স্থানে না বসানো। আর যদি তারা এ দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে যেন মুসলিমরা তাদেরকে সাক্ষী রেখে নিজেদেরকে মুসলিম হওয়ার ঘোষণা দেয়।
ইহুদী-খৃষ্টানরা দাবী করতো ইব্রাহীম (আ.) তাদের ধর্মের অনুসারী ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) মাধ্যমে তাদের এ অযৌক্তিক দাবীর জবাব দেন। তারা কিভাবে ইব্রাহীমকে (আ.) ইহুদী অথবা খৃষ্টান হওয়ার দাবী করে? অথচ ইব্রাহীমের (আ.) আগমণ হয়েছে তাদের চেয়ে হাজার হাজার বছর পূর্বে। তারা নিজেদের দাবীর ব্যাপারে অন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তারা কি বলছে? তা উপলব্দি করতে পারছে না।
তারা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে তাদের ধর্মীয় বিষয়, যা সম্পর্কে তারা ধারণা রাখে, সে বিষয়ে তর্ক করলে তা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু তারা কেন ইব্রাহীমের (আ.) বিষয়ে তর্ক করে? যার সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই। তারা যে বিষয়ে তর্ক করে তার হাকীকত সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না, বরং আল্লাহ তায়ালাই সাম্যক জ্ঞাত।
আসল কথা হলো: ইব্রাহীম (আ.) ইহুদী অথবা খৃষ্টান কোনটাই ছিলেন না; কারণ তিনি ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম আসার বহু পূর্বে এসেছেন। বরং তিনি ছিলেন আল্লাহ তায়ালার একান্ত অনুসারী এবং তিনি মুশরিকদের দলভুক্তও ছিলেন না।
তিন শ্রেণীর মানুষ ইব্রাহীমের (আ.) আপনজন: (ক) যারা তার অনুসরণ করেছে, (খ) যারা মোহাম্মদের (সা.) অনুসরণ করে এবং (খ) যারা ঈমান গ্রহণ করেছে। আর আল্লাহ হলেন মুমিনদের অভিভাবক এবং কাফেরৃ-মুশরিকদের শত্রæ। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩২৮, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৮, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৬) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿أَهْلَ الْكِتَابِ﴾ “আহলুল কিতবা”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ইহুদী এবং খৃষ্টান জাতি; কারণ ইহুদীদের উপর তাওরাত এবং খৃষ্টানদের উপর ইনজীল অবতীর্ণ হয়েছে। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩২৭) ।
﴿كَلِمَةٍ سَوَاءٍ﴾ “সাম্যের বাণী”, আয়াতাংশ দ্বারা তাওহীদের কালেমাকে বুঝানো হয়েছে, যা তিনটি বিষয়কে অন্তর্ভূক্ত করে: (ক) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা, (খ) তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা এবং (গ) নিজেদের মধ্যে কাউকে বিভিন্ন উপাদিতে ভ‚ষিত করে রবের স্থানে না বসানো। (সূরা আলে-ইমরান: ৬৪) ।
﴿أَرْبَابًا﴾ “রবসমূহ”, আয়াতাংশে ‘আরবাব’ শব্দটি আরবী, যা ‘রব’ শব্দের বহুবচন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: আল্লাহর অনুসরণ বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অনুসরণীয় মাবুদ বানানো। (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/৩২৭) ।
﴿حَنِيفاً مُسْلِماً﴾ “একনিষ্ঠ মুসলিম”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: বাতিল ধর্ম থেকে বিমুখ হয়ে সত্য ধর্মের দিকে ফিরে আসা। (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/৩২৭) ।

(৬৫-৬৭) নাম্বার আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নাজরান থেকে খৃষ্টানদের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে এসে দাবী করলো যে ইব্রাহীম (আ.) খৃষ্টান ছিলেন এবং ইহুদী আহবাররা দাবী করলো যে ইব্রাহীম (আ.) ইহুদী ছিলেন। তাদের এ ভ্রান্ত দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা অত্র সূরার (৬৫-৬৭) আয়াতাবলী অবতীর্ণ করেন। (আসবাব আল-নুযূল, সুয়ূতী: ৬৩-৬৪) ।
ইহুদীরা রাসূলুল্লাহকে (সা.) বললো: ইব্রাহীম (আ.) ইহুদী হওয়ার কারণে আমরা তোমাদের চেয়ে তার বেশী নিকটবর্তী। আর এগুলো দেখে তুমি আমাদের সাথে হিংসা করে বেড়াচ্ছো। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা অত্র সূরার ৬৮ নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করে ইব্রহীমের (আ.) প্রকৃত আপনজন সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৫১) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। চৌষাট্টি নাম্বার আয়াতে চারটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) অত্র আয়াতে ইহুদী-খৃষ্টান সহ সকল আহলে কিতাবকে সম্বোধন করা হয়েছে; কারণ তারা তাদের আলেমদেরকে রব বানিয়েছে। একবার রাসূলুল্লাহকে (সা.) বলা হলো তারা তো তাদের আলেমদের ইবাদত করে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিলেন তারা কি তাদের আলেমগণ আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত বস্তুর মধ্যে যা হালাল করে তাকে হালাল মনে করে এবং হালালকৃত বস্তু যা হারাম করে তাকে হারাম মনে করে? সাহাবায়ে কিরাম বললেন: হ্যা, ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন: এটাই ইবাদতের নাম্বান্তর। (সুনান আল-তিরমিযী: ৩০৯৫, হাদীসটি হাসান) । এ সম্পর্কে সূরা তাওবার একত্রিশ নাম্বার আয়াতে বর্ণনা এসেছে, সেখানে বলা হয়েছে:
﴿اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾ [سورة التوبة: ৩১].
অর্থাৎ: “তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের আহবার ও রুহবানদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং ঈসা ইবনু মারইয়ামকেও। অথচ তারা আদিষ্ট হয়েছিল কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করতে যিনি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই, তারা যে শিরক করে তা থেকে আল্লাহ পুতপবিত্র” (সূরা তাওবা: ৩১) ।
(খ) আয়াতে তাওহীদের কালেমা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: (ক) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা, (খ) তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা এবং (গ) নিজেদের মধ্যে কাউকে বিভিন্ন উপাদিতে ভ‚ষিত করে রবের স্থানে না বসানো। (সূরা আলে-ইমরান: ৬৪) ।
(গ) যারা ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে একজন মুসলিম তাদেরকে নিজের মুসলিম হওয়ার ব্যাপারে সাক্ষী রেখে তাদেরকে তাদের পথে ছেড়ে দিবে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৫৩) ।
(গ) রাসূলুল্লাহ (সা.) রোম, পারস্য এবং হাবশা সহ যত দেশের রাজা-বাদশাহের কাছে ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত চিঠি পাঠিয়েছেন অত্র আয়াত তার সারমর্ম। যেমন: সহীহ মুসলিমে বর্ণিত রোম স¤্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে পাঠানো চিঠিটি উল্লেখযোগ্য, যেখানে বলা হয়েছে:
“بسم الله الرّحمن الرّحيم. من محمد رسول الله إلى هرقل عظيم الرّوم. سلام على من اتّبع الهدى، أما بعد: فإني أدعوك بدعاية الإسلام، أسلم تسلم، وأسلم يؤتك الله أجرك مرتين، فإن توليت، فإن عليك إثم الأريسيين- أي الشعب من فلاحين وخدم وأتباع وغيرهم، ويا أَهْلَ الْكِتابِ تَعالَوْا إِلى كَلِمَةٍ سَواءٍ بَيْنَنا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ، وَلا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئاً، وَلا يَتَّخِذَ بَعْضُنا بَعْضاً أَرْباباً مِنْ دُونِ اللَّهِ، فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا: اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ”.
অর্থাৎ: “পরম করুণাময় আল্লাহর নামে। আল্লাহর রাসূল মোহাম্মদের পক্ষ থেকে রোম স¤্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে। হেদাকামীদের প্রতি আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক। আমি আপনাকে ইসলামের দিকে দাওয়াত করছি। আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি, আপনিও ইসলাম গ্রহণ করুন। আপনি ইসলাম গ্রহণ করলে দ্বিগুণ সাওয়াব প্রদান করা হবে। আর যদি প্রত্যাক্ষ্যান করেন, তাহলে আপনার দেশের জনগণের পাপের বোঝাও আপনাকে বহণ করতে হবে। অতঃপর অত্র আয়াতটি উল্লেখ করলেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৫৩) ।
(ঘ) উল্লেখিত আয়াতে দুই প্রকার তাওহীদের বর্ণনা এসেছে: (ক) “আমরা যেন আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত না করি” আয়াতাংশ দ্বারা ‘তাওহীদ আল-উলুহিয়্যাহ’ এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (খ) “আমরা যেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের মধ্যে কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ না করি” আয়াতাংশ দ্বারা ‘তাওহীদ আল-রুবুবিয়্যাহ’ এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে সকল নবী-রাসূলগণ মানবজাতিকে তাওহীদের দিকে আহবান করেছেন। যেমন: আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন:
﴿وَما أَرْسَلْنا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ: لا إِلهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ﴾ [سورة الأنبياء: ২৫].
অর্থাৎ: “আমি আপনার পূর্বের সকল নবীকে এই মর্মে অহী প্রদান করেছি যে, আমি ছাড়া কোন হক্ব ইলাহ নেই, অতএব তোমরা কেবল আমারই ইবাদত করো” (সূরা আল-আনবিয়া: ২৫) ।
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ، وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾ [سورة النحل: ৩৬].
অর্থাৎ: “অবশ্যই আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছে এ নির্দেশ দিয়ে রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা কেবল আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে পরিহার করো” (আল-নাহল: ৩৬) ।
২। ইহুদী-খৃষ্টানদের দাবী ইব্রাহীম (আ.) ইহুদী অথবা খৃষ্টান ছিলেন। তাদের এ ভ্রান্ত দাবীর জবাবে আল্লাহ তায়ালা (৬৫-৬৮) আয়াতে সংলাপমূলক পদ্ধতিতে প্রমাণ করেছেন যে তিনি ইহুদী, খৃষ্টান এবং মুশরিক কোনটিই ছিলেন না:
প্রথমত: আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি আল-সুয়াল আল-ইজবারী বা বাধ্যতামূলক প্রশ্ন ছুড়ে মেরেছেন, তারা কিভাবে ইব্রাহীমকে (আ.) ইহুদী-খৃষ্টান হওয়ার দাবী করতে পারে, অথচ তার আগমণ হয়েছে ইহুদী-খৃষ্টান নামে দুইটি ধর্মের প্রবর্তনের অনেক আগে?
দ্বিতিয়ত: তাদের বোকামী ও অজ্ঞতাকে প্রকাশ করে দিয়েছেন, মূসা এবং ঈসা (আ.) সম্পর্কে তাদের জানা থাকার কারণে কথা বলাতে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু তারা কিভাবে ইব্রাহীমকে (আ.) নিয়ে কথা বলে, যার সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই।
তৃতীয়ত: ইব্রাহীম (আ.) আসলে কোন ধর্মের ছিলেন, সে বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে দিয়েছেন, তিনি ইহুদী, খৃষ্টান এবং মুশরিক কোনটারই অনুসারী ছিলেন না, বরং তিনি একজন খাটি আল্লাহর অনুসারী ছিলেন।
চত‚র্থত: ইব্রাহীমের (আ.) সাথে কাদের সুসম্পর্ক বেশী তা প্রকাশ করেছেন, তার সাথে ইহুদী, খৃষ্টান ও মুশরিকদের কোন সম্পর্ক নেই, বরং সম্পর্কের দিক থেকে তার আপনজন হলো তিন শ্রেনীর মানুষ: (ক) যারা তার অনুসরণ করেছে, (খ) যারা মোহাম্মদের (সা.) অনুসরণ করে এবং (খ) যারা ঈমান গ্রহণ করেছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৫৫) ।
৩। উল্লেখিত আয়াতাবলী থেকে বুঝা যায় সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনে তর্ক করা ওয়াজিব। এ সম্পর্কে সূরা নাহল এর ১২৫ নাম্বার আয়াত সহ আরো অনেক আয়াত রয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৫৭) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) একজন দায়ী সর্বদা মানবজাতিকে তাওহীদের দিকে আহবান করবে।
(খ) সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনে তর্ক করা যাবে।
(গ) যে বিষয়ের জ্ঞান রয়েছে, কেবল সে বিষয়ে তর্ক করা যাবে।

error: Content is protected !!