Skip to main content

সূরা আলে-ইমরানের (৭৯-৮০) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: নবী-রাসূলদের প্রতি ইহুদী-খৃষ্টানদের অপবাদ ও তার জবাব।

﴿مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِي مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ كُونُوا رَبَّانِيِّينَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُونَ (79) وَلَا يَأْمُرَكُمْ أَنْ تَتَّخِذُوا الْمَلَائِكَةَ وَالنَّبِيِّينَ أَرْبَابًا أَيَأْمُرُكُمْ بِالْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (80)﴾ [سورة آل عمران: 79-80].

আয়াতদ্বয়ের আলোচ্যবিষয়: নবী-রাসূলদের প্রতি ইহুদী-খৃষ্টানদের অপবাদ ও তার জবাব।

আয়াতদ্বয়ের সরল অনুবাদ:
৭৯। হে ইহুদী-খৃষ্টান সম্প্রদায়! জেনে রেখ কোন মানুষের জন্য সংগত নয় যে আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমাত এবং নবুয়াত দিবেন, অতঃপর সে মানুষকে বলবে: তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমার বান্দা হয়ে যাও, বরং সে বলবে: তোমরা আল্লাহ-ভক্ত হয়ে যাও, যেহেতু তোমরা শিক্ষা দিতে কিতাব এবং তা অধ্যায়ন করতে।
৮০। আর তোমাদেরকে নির্দেশ দিবেন না তোমরা ফেরেশতাদেরকে এবং নবীদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করো, তিনি কি তোমাদেরকে নির্দেশ দিবেন কুফরীর তোমাদের মুসলিম হয়ে যাওয়ার পরও।

আয়াতদ্বয়ের ভাবার্থ:
নাজরান থেকে আগত খৃষ্টান প্রতিনিধি দল, যারা ঈসাকে (আ.) ইলাহ হিসেবে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তায়ালা তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের জবাবে বলেন: একজন মানুষকে আল্লাহ তায়ালা নবী হিসেবে নির্বাচন করে তাকে কিতাব ও হিকমাত দিবেন আর তিনি চাইবেন সাধারণ মানুষ আল্লাহকে বাদ দিয়ে তার ইবাদত-বন্দেগী করবে, এটা কখনও সমিচীন নয়। আর এ রকম ঘটনা অতিতে কখনও ঘটেনি এবং ভবিষ্যতে কখনও ঘটবে না। সুতরাং হে খৃষ্টান প্রতিনিধি দল, তোমরা কিভাবে একজন নবী ঈসাকে (আ.) আল্লাহর স্থানে বসিয়ে তার ইবাদত-বন্দেগী করতে পারো!? বরং একজন নবী হিসেবে তিনি সর্বদা তোমাদেরকে কিতাব শিক্ষা এবং তা চর্চা করার মাধ্যমে আল্লাহ ভক্ত হতে বলেছেন।
আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে সাফ জানিয়ে দিলেন, তিনি কখনও কাউকে আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন ফেরেশতা অথবা পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের কারো ইবাদত-বন্দেগী করার নির্দেশ দেননি; কারণ সকল নবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য এবং মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর দিকে আহবান করার জন্য। তিনি কিভাবে তোমাদেরকে কুফরের নির্দেশ দিতে পারেন, অথচ তার দাওয়াতেই তো তোমরা এক আল্লাহর কাছে আত্মসমার্পন করে মুসলিম হয়েছো। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৩৭, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৬০, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৮) ।

আয়াতের বিরল শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿رَبَّانِيِّينَ﴾ “আল্লাহ ভক্ত”, আয়াতাংশে ‘আল্লাহ ভক্ত’ দ্বারা যিনি আল্লাহ সম্পর্কে জানেন এবং তাঁর অনুসরণ করেন, তাকে বুঝানো হয়েছে। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবা: ১/৯৬)।
﴿الْكُفْرِ﴾ “কুফরী করা”, আয়াতাংশ দ্বারা ইসলাম থেকে মুরতাদ হয়ে যাওয়াকে বুঝানো হয়েঝে। (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/৩৩৭) ।
﴿مِنْ دُونِ اللَّهِ﴾ “আল্লাহকে বাদ দিয়ে”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: আল্লাহর হক্বের সীমাকে অতিক্রম করে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা অথবা কাউকে শরীক করার নির্দেশ দেওয়া। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৯৬, তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৭৫) ।
(৭৯) আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: আবু রাফী আল-কুরাজী বলেন: নাজরান থেকে আগত ইহুদী-খৃষ্টানদের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে জমায়েত হলে তিনি তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করলে তারা জবাবে বললো: তুমি কি চাও আমরা তোমার ইবাদত-বন্দেগী করি যেমনিভাবে খৃষ্টানরা ঈসার (আ.) ইবাদত করে থাকে? তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: তোমাদের এ ভ্রান্ত কথা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা উনাশি নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করলেন।
আরেক বর্ণনায় এসেছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে এসে বললো: হে আল্লাহর রাসূল আমরা পরস্পরে যেভাবে সালাম বিনিময় করে থাকি, আপনার সাথেও তেমনি সালাম বিনিময় করি। এটা আপনার শানে বেমানান, আমরা কি আপনাকে সাজদা করতে পারি না? তিনি উত্তরে বললেন: না, কখনও সাজদা করবে না, বরং নবীদেরকে সম্মান করবে এবং সত্যকে বুঝবে অন্যকে জানিয়ে দিবে। জেনে রেখো, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সাজদা করা যায় না। (লুবাব আল-নুক‚ল, সুয়ূতী: ৬৫-৬৬) ।
পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে অত্র আয়াতদ্বয়ের সম্পর্ক:
আল্লাহ এবং তাঁর কিতাবের সাথে ইহুদী-খৃষ্টানদের মিথ্যাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে আর অত্র আয়াতদ্বয়ে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে তাদের মিথ্যাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৯৫) ।

আয়াতের শিক্ষা:
১। উনাশি নাম্বার আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে,
(ক) যাকে নবী হিসেবে নির্বাচন করা হয়, অথবা যে আলেমে রব্বানী হয় সে কখনও কাউকে নিজের আবিষ্কৃত আদর্শের দিকে আহবান করতে পারে না।
(খ) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাগ্যবান ও মহৎ সে ব্যক্তি, যে আল্লাহর ভয়ে নিজে দ্বীনী জ্ঞান শিখে সে অনুযায়ী আমল করে এবং অন্যকে সংসোধনের উদ্দেশ্যে তা শিক্ষা দেয়। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়েরী: ১/৩৩৮) ।
২। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন নবী-রাসূল কেমন হবেন? এবং তার দায়িত্ব কি হবে? সে বিষয়ে উল্লেখিত আয়াতদ্বয় সহ কোরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে যা জানা যায়, তা হলো:
(ক) একজন নবী সর্বদা মানব জাতিকে তাওহীদ বা একত্ববাদের দিকে আহবান করবে, যেমন একটি আয়াতে এসেছে, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
﴿وَما أَرْسَلْنا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لا إِلهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ﴾ [سورة الأنبياء: ২৫].
অর্থাৎ: “আমি আপনার পূর্বে যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছি সকলকে জানিয়ে দিয়েছি আমি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই, অতএব তোমরা আমার একত্ববাদের ঘোষণা দাও” (সূরা আল-আনবিয়া: ২৫) । অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে:
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾ [سورة النحل: ৩৬].
অর্থাৎ: “অবশ্যই আমি সকল উম্মতের কাছে এ নির্দেশ দিয়ে নবী-রাসূল পাঠিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দাও এবং তাগুতকে ত্যাগ করো” (সূরা আন-নাহল: ৩৬) ।
(খ) মানব জাতিকে দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা দিবে, যার ইঙ্গিত ৭৯ নং আয়াতের শেষাংশে রয়েছে। এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা কোরআনের সূরা বাক্বারা এর ১২৯, সূরা আলে-ইমরানের ১৬৪ এবং সূরা জুমুয়াহ এর ২ নাম্বার আয়াতে রাসূলুল্লাহকে (সা.) জাতির প্রশিক্ষক বলা হয়েছে।
(গ) মানব জাতিকে নিজের বানানো আদর্শের দিকে আহবান না করে, তাদের কাছে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাবে। ৭৯ নাম্বার আয়াতে এ কথার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে আরেকটি আয়াতে এসেছে:
﴿يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ﴾ [سورة المائدة: ৬৭].
অর্থাৎ: “হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ থেকে যা তোমার উপর অবতীর্ণ হয়েছে, তা মানব জাতির কাছে পৌঁছে দাও। যদি তা না করো, তাহলে তুমি আল্লাহর রিসালাতকে পৌঁছাতে পারনি। আর আল্লাহ তোমাকে মানবজাতি থেকে রক্ষা করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হেদায়েত দান করেন না” (সূরা মায়িদাহ: ৬৭) ।
(ঘ) মানব জাতিকে তো শিরকের দিকে আহবান করবেই না, বরং শিরকে লিপ্ত হলে তাদেরকে সংশোধন করবে, এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা সূরা বাক্বারা এর ১২৯, সূরা আলে-ইমরানের ১৬৪ এবং সূরা জুমুয়াহ এর ২ নাম্বার আয়াতে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
(ঙ) মানব জাতিকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে এবং জাহান্নামের ভয় দেখাবে, যেমন: এ বিষয়ে সূরা আনয়াম এর ৪৮ এবং সূরা কাহ্ফ এর ৫৬ নাম্বার আয়াতে এসেছে:
﴿وَمَا نُرْسِلُ الْمُرْسَلِينَ إِلَّا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ﴾ [سورة الأنعام: ৪৮، سورة الكهف: ৫৬].
অর্থাৎ: “আমি সকল নবী-রাসূদেরকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা এবং ভীতি প্রদর্শণকারী হিসেবে” (সূরা আনয়াম: ৪৮, সূরা কাহ্ফ: ৫৬)।
৩। আশি নাম্বার আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজের আবিষ্কৃত মতাদর্শের দিকে তো আহবান করা যাবেই না, বরং পছন্দসই বহুল প্রচলিত কোন আদর্শের দিকেও ডাকা যাবে না। কারণ, আয়াতে দেখা যায় একজন নবী কোন ফেরেশতা অথবা প্রশিদ্ধ নবী-রাসূলকে রব হিসেবে গ্রহণ করার দিকে আহবান করবে তা থেকেও নিষেধ করা হয়েছে। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

৪। আশি নাম্বার আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ইহুদী-খৃষ্টানদের অযৌক্তিক দাবীর জবাব দিয়ে বলেছেন যে, একজন মানুষ যখন কাউকে ইসলাম ও তাওহীদের দিকে আহবান করে এবং সে মুসলিম হয়ে যায়, এর পর তাকে পুনরায় ‍শিরকের দিকে দাওয়াত দিতে পারে না।

আয়াতদ্বয়ের আমল:
১। আল্লাহর পথের একজন দায়ী কখনও কাউকে শিরকের দিকে আহবান করবে না।
২। শরীয়াতের জ্ঞান অর্জন করা এবং তা জীবনে বাস্তবায়ন করা।
৩। আল্লাহ প্রদত্ব ইসলামী আদর্শকে বাদ দিয়ে সমাজে প্রচলিত মানব রচিত আদর্শকে গ্রহণ করা যাবে না।

Leave a Reply

error: Content is protected !!