يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا فَرِيقًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ يَرُدُّوكُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ كَافِرِينَ (100) وَكَيْفَ تَكْفُرُونَ وَأَنْتُمْ تُتْلَى عَلَيْكُمْ آيَاتُ اللَّهِ وَفِيكُمْ رَسُولُهُ وَمَنْ يَعْتَصِمْ بِاللَّهِ فَقَدْ هُدِيَ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ (101) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (102) وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ (103) [سورة آل عمران: 100-103]
আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: নিজকে রক্ষা এবং ইসলামের সাথে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকার নির্দেশ।
আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
১০০। হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আহলে কিতাবের থেকে একটি দলের অনুসরণ করো, তাহলে তারা তোমাদেরকে তোমাদের ঈমানের পরে কাফের অবস্থায় ফিরিয়ে নিবে।
১০১। আর তোমরা কিভাবে কুফরী করবে? অথচ তোমরা এমন যে যাদের কাছে আল্লাহর আয়াতাবলী পাঠ করা হয় এবং তোমাদের কাছে রয়েছে তাঁর রাসূল, আর যে আল্লাহর পথ আকড়ে করবে, সে সৎপথ পাবে।
১০২। হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথ ভয় করো, আর মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করিও না।
১০৩। আর তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে ধারণ করো এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না। স্মরণ করো আল্লাহর নেয়ামতকে, যা তোমাদের প্রতি রয়েছে, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের অন্তরে ভালোবাসার সঞ্চার করেছেন, ফলে তোমরা তার দয়ায় পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা ছিলে জাহান্নামের গর্তের কিনারায়। অতঃপর তিনি তা থেকে রক্ষা করেছেন । এভাবে, আল্লাহ তোমাদের জন্যে তার আয়াতাবলী বর্ণনা করেছেন, যাতে হেদায়েত পাও।
আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
আহলে কিতাব মুমিনদেরকে ক্ষতি ও তাদেরকে ইসলাম থেকে বিরত রাখার জন্য সর্বদা উদগ্রীব থাকে, যা পূর্বের আয়াত সহ কোরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয়। এজন্য আল্লাহ তায়ালা উল্লেখিত আয়াতসমূহে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচার জন্য মুমিনদেরকে কয়েকটি করণীয় বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন:
(ক) মুমিনরা যেন ইহুদীদের সকল ষঢ়যন্ত্র ও ইসলাম সম্পর্কে তাদের বানোয়াট বিষয়কে এড়িয়ে চলে, তাদেরকে এড়িয়ে চলতে পারলে ঈমানদারগণ তাদের ঈমান নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারবে। অন্যথায় কুফরে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একজন মুমিন ঈমান গ্রহণের পর কাফির হয়ে যাওয়া আশ্চর্যজনক ও বিরল ঘটনা; কারণ তার সামনে কোরআন তেলাওয়াত করে শুনানো হচ্ছে এবং তার কাছে এমন একজন রাসূল (সা.) রয়েছেন যিনি সব সময় তাকে নসিহত ও সতর্ক করছেন। এজন্য তার মনে রাখা উচিৎ আল্লাহর সাথে সুসম্পর্ক রাখলে সরল পথে চলা সহজ হয়।
(খ) মুমিনদের উচিৎ ইহুদীদের চক্রান্তে পা না দিয়ে আল্লাহকে যথাসম্ভব ভয় করা এবং আমরণ ইসলামের পথে থাকা। তাহলেই তারা ঈমান ও ইসলাম নিয়ে সারা জীবন নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারবে।
(গ) ইহুদীদের ষড়যন্ত্র থেকে বাচার জন্য মুমিনদের তৃতীয় করণীয় হলো: বিচ্ছিন্ন না হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামকে ধারণ করা। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থেকে ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপন আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় নেয়ামত। যে নেয়ামত তিনি মদীনার আওস ও খাযরাজ গোত্রকে দিয়েছিলেন। তাদের দীর্ঘ দিনের শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে ভ্রাতৃত্বের প্লাটফর্মে এনে দিয়েছিলেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা তার নেয়ামতের কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেন, যাতে তারা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং নেয়ামতের মূল্যায়ন করে। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়েরী: ১/৩৫৪-৩৫৫, তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৪/২৬, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৬৩, আল-মোন্তাখাব: ১/১০২-১০৩) ।
আয়াতাবলীর বিরল শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿آيَاتُ اللَّهِ﴾ ‘আল্লাহর নিদর্শনসমূহ’, দ্বারা কোরআনের আয়াতসমূহকে বুঝানো হয়েছে। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩৫৩) ।
﴿حَقَّ تُقَاتِهِ﴾ ‘তাঁকে যথার্থ ভয়’, আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় করা মানুষের পক্ষে পুরোপুরি সম্ভব নয়। এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কিরাম (রা.) রাসূলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, “আমরা কীভাবে আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় করব?” তখন আরেকটি আয়াত নাযিল করে বলা হয়েছে: “তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যতটুকু সম্ভব”। সুতরাং এ আয়াতে আল্লাহকে ভয় করা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- “আল্লাহর আদেশসমূহ পালন করা এবং তাঁর নিষেধাজ্ঞাগুলো থেকে যথাসাধ্য বেঁচে থাকা”। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়েরী: ১/৩৫১) ।
﴿بِحَبْلِ اللَّهِ﴾ ‘আল্লাহর রজ্জুকে’, আয়াতাংশে ‘আল্লাহর রজ্জু’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: আল্লাহর দীন, আর আল্লাহর মনোনিত দীন হলো- ইসলাম। সুতরাং আয়াতে ‘আল্লাহর রজ্জু দ্বারা ‘ইসলাম’ ধর্মকে বুঝানো হয়েছে। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবাহ: ১/৯৬) ।
﴿نِعْمَتَ اللَّهِ﴾ ‘আল্লাহর নেয়ামত’, এখানে ‘আল্লাহর নেয়ামত’ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা যে ‘আওস’ ও ‘খাযরাজ’ গোত্রদ্বয়ের মধ্যকার দীর্ঘদিনের শত্রæতাকে ভুলিয়ে দিয়ে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক তৈরি করে দিলেন তার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কারণ, ভ্রাতৃত্ব হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বড় নেয়ামত। এ সম্পর্কে কোরানের আরেকটি আয়াতে এসেছে:
﴿لَوْ أَنْفَقْتَ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا مَا أَلَّفْتَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ أَلَّفَ بَيْنَهُمْ إِنَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾ [سورة الأنفال: ৬৩].
অর্থাৎ: “তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব তৈরি করার জন্য যমীনের সবকিছু ব্যয় করলেও তুমি তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব তৈরি করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব তৈরি করে দিলেন। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (সূরাতু আল-আনফাল: ৬৩) ।
উল্লেখিত আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতের সম্পর্ক:
অত্র সূরার (৯৮-৯৯) নং আয়াতে মুসলিমদেরকে তাদের ধর্ম থেকে বিমুখ করার জন্য ইহুদীদের চক্রান্তের কথা তুলে ধরা হয়েছে। আর অত্র আয়াতাবলীতে তাদের চক্রান্ত থেকে মুসলিমদেরকে আত্মরক্ষার জন্য কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং পূর্বের আয়াতের সাথে অত্র আয়াতাবলীর সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মারাগী: ৪/১৫) ।
(১০০-১০৫) নাম্বার আয়াতাবলী অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
যায়েদ ইবনু আসলাম (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন আওস ও খাযরাজ গোত্রের কিছু সাহাবিকে একসঙ্গে বসে গল্প করতে দেখে ‘শাস ইবনু কাইস’ নামক ইহুদী খুবই রাগান্বিত ও ক্ষুদ্ধ হলো। তখন সে তার সাথে থাকা এক যুবক ইহুদিকে নির্দেশ দিল: “যাও, ওদের মাঝে বসো। অতীতের ‘ইয়াওমে বুয়াথ’ এর কথা স্মরণ করিয়ে দাও। সে যুবক তাই করল। সাহাবারা সেই সব পুরনো কথাবার্তায় মেতে উঠলেন। তারা তর্কে জড়িয়ে পড়লেন এবং গর্ব করতে শুরু করলেন। এক পর্যায়ে দুই ব্যক্তি একজন আওসের (আওস ইবন কাইজি) এবং অন্যজন খাযরাজের (জাব্বার ইবন সাখর) উঠে দাঁড়াল এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করতে লাগল। এই খবর রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে পৌঁছলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্যে সমাধান করে দিলেন।
উভয় পক্ষ বুঝতে পারল এটি ছিল শয়তানের প্ররোচনা এবং তাদের শত্রু ‘শাস ইবন কাইস’ এর ষড়যন্ত্র। তারা লজ্জিত হয়ে হাতের অস্ত্র ফেলে দিল, কেঁদে ফেলল এবং আওস ও খাযরাজের লোকেরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। পরে তারা সবাই রাসুলুল্লাহর (সা.) কথা শুনে তার সঙ্গে শান্ত চিত্তে ফিরে গেল। এইভাবে আল্লাহ তাদের উপর থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা এবং ‘শাস ইবনু কাইস’ এর চক্রান্ত দূর করে দিলেন। তখন আল্লাহ তায়ালা আওস-খাযরাজ গোত্রের আনসারী সাহাবীদের সম্পর্কে (১০০-১০৫) আয়াতাবলী অবতীর্ণ করেন। (আসবাব আল-নুযূল, সুয়ূতী: ৬৭) ।
আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। ১০০নং আয়াত থেকে দুইটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) একজন মুমিন কখনও ইহুদীদের অনুসরণ করবে না।
(খ) ইহুদীদের অনুসরণ করলে সে কাফির হয়ে যাবে; কারণ তারা বিদ্বেষ বশত সর্বদা মুমিনদেরকে কাফের এ রুপান্তরিত করতে চায়।
এ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার একটি আয়াতে এসেছে:
﴿وَدَّ كَثِيرٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتابِ لَوْ يَرُدُّونَكُمْ مِنْ بَعْدِ إِيمانِكُمْ كُفَّاراً، حَسَداً مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِهِمْ﴾ [سورة البقرة: ১০৯].
অর্থাৎ: “অনেক ইহুদীরা বিদ্বেষের কারণে তোমাদের ঈমান গ্রহণের পর পুনরায় তোমাদেরকে কাফেরে রুপান্তরিত করতে চায়” (সূরাতু আল-বাক্বারা: ১০৯) ।
এছাড়াও সূরা আলে-ইমরানের আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে: মুমিনরা যেন কাফেরদের অনুসরণ থেকে বিরত থাকে, অন্যথায় তাদের ধোকায় পড়ে তারা জাহিলিয়্যাতের দিকে ফিরে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا الَّذِينَ كَفَرُوا يَرُدُّوكُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَاسِرِينَ﴾ [سورة آل عمران: ১৪৯].
অর্থাৎ: “হে মুমিনগণ! তোমরা যদি কাফেরদের অনুসরণ করো, তাহলে এরা তোমাদেরকে জাহিলিয়্যাতের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, ফলে তোমরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে” (সূরাতু আলে ইমরান: ১৪৯) ।
সুতরাং একজন মুমিন ইহুদী-খৃষ্টান ও কাফের-মোশরেকদের অনুসরণ না করলে সে নিজেকে ঈমানের সাথে সংরক্ষণ করতে পারবে। অন্যথায় সেও তাদের মতো কাফের হয়ে যাবে।
২। ১০১নং আয়াত থেকে বুঝা যায় কোন মুমিনের মধ্যে দুইটি গুণ পাওয়া গেলে, সে হিদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, জীবনে কখনও কুফরীতে পতিত হবে না:
(ক) আন্তরিকভাবে বুঝে কোরআন তেলাওয়াত করা।
(খ) রাসূলুল্লাহর (সা.) অনুসরণ করা। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৪/২৬) । এ সম্পর্কে একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ، لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ” (موطأ مالك: ৩).
অর্থাৎ: “আমি তোমাদের কাছে দুইটি বিষয় রেখে গেলাম, যতক্ষন পর্যন্ত তোমরা তা মজবুতভাবে ধারণ করবে, ততক্ষণে পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাত” (মুয়াত্তা মালিক: ৩)। শরয়ী কোন মাসয়ালা নিয়ে দুই দল আলেমের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে, তা সমাধানের জন্য আল্লাহ তায়ালা কোরআন-সুন্নাহর দিকে ফিরে আসতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে সূরা নিসা এর একটি আয়াতে এসেছে:
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا﴾ [سورة النساء: ৫৯].
অর্থাৎ: “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর অনুসরণ করো এবং তাঁর রাসূলের অনুসরণ করো ও তোমাদের মধ্যকার উলুল আমরের। যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিরোধে লিপ্ত হও, তবে তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি সত্যিকারের ঈমানদার হয়ে থাকলে তা সমাধানের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরে এসো। এটাই হলো উত্তম উপায় এবং সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি” (সূরা নিসা: ৫৯) ।
৩। ১০২নং আয়াত থেকে দুইটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ইহুদীদের চক্রান্ত থেকে বাঁচার জন্য একজন মুমিনের দ্বিতীয় করণীয় বিষয় হলো: আল্লাহর আদেশ মেনে চলা এবং তাঁর নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহকে ভয় করা।
(খ) একজন প্রকৃত মুমিনের উচিত, সে যেন কোনো অবস্থাতেই ধর্মত্যাগ না করে এবং মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করে, এই লক্ষ্যেই জীবন-যাপন করে”। রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি দোয়া শিখিয়েছেন:
“يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِى عَلَى دِينِكَ” [سنن الترمذي: ২২৯০].
অর্থাৎ: ‘হে অন্তরের পরিবর্তনকারী! আমার আত্মাকে আপনার দীনের উপর অটল রাখুন” (সুনান আল-তিরমিযী: ২২৯০) ।
সয়ং আল্লাহ তায়ালা একটি দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, যা কোন মুমিন প্রতিদিন পাঠ করলে সে আমরণ ঈমান থেকে বিচ্যুত হবে না। দোয়াটি হলো-
﴿رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ﴾ [سورة آل عمران: ৮].
অর্থাৎ: “হে আমাদের রব! হেদায়েত দানের পরে আমাদের অন্তরকে বক্র করে দিয়েন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন, নিশ্চয় আপনি দানশীল” (সূরাতু আলে-ইমরান: ৮) ।
৪। ১০৩নং আয়াত থেকে কয়েকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ইহুদীদের চক্রান্ত থেকে বাঁচার জন্য মুমিনদের উচিৎ ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামকে ধারণ করা।
(খ) তারা মুমিনদের সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরানোর জন্য চেষ্টায় কোন ত্রæটি করবে না, সে ক্ষেত্রে মুমিনরা যেন তাদের ষঢ়যন্ত্রে পা দিয়ে বিচ্ছিন্ন না হয়।
(গ) মুমিনদেরকে ভ্রাতৃত্ব নামক বিশাল নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে আয়াতের শেষাংশে; যেই ভ্রাতৃত্বকে ভুলে গিয়ে আওস এবং খাযরাজ গোত্রদ্বয় আবারও শত্রæতার দিকে ধাবিত হয়েছিল।
(ঘ) আল্লাহ তায়ালার একটি নিয়ম হলো- মানবজাতির হেদায়েতের জন্য তিনি শরয়ী বিধানকে তাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দেন। এখানেও নির্দেশ দিয়েছেন যে, মুমিনগণ যেন আল্লাহর দেওয়া নির্দেশনা ও আয়াতসমূহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।
৫। উল্লেখিত আয়াতসমূহ গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, ইহুদীদের ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে নিজেদের ঈমানকে রক্ষা ও সুরক্ষিত রাখতে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের উপর পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আরোপ করেছেন:
(ক) ইহুদীদের ষড়যন্ত্র ও ইসলামবিরোধী মনগড়া বক্তব্য থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
(খ) আল্লাহকে সর্বোচ্চ ভয় করে আমৃত্যু ইসলামের পথে অটল থাকা।
(গ) ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থেকে ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থাকা।
(ঘ) ইহুদীদের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে দলাদলি বা বিভাজনে না জড়ানো।
(ঙ) আল্লাহর দেয়া নির্দেশনা ও আয়াতসমূহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সঠিক পথে চলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকের মুসলিম উম্মাহ আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত এই পাঁচটি করণীয় থেকে বিচ্যুত হওয়ার ফলেই ইহুদিদের সামনে অত্যন্ত দুর্বল ও অসহায় অবস্থায় পরিণত হয়েছে। এর পরিণতিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিম নারী ও শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে, অথচ মুসলিম জাতি তা প্রতিরোধ করার মতো শক্তি বা ঐক্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে।
৬। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সূরা আলে ইমরানের ১০২ নম্বর আয়াতের প্রথমাংশ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযোগ্যরূপে ভয় করো” নাজিল হলে, সাহাবায়ে কিরাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমরা সাধারণ মানুষ; আল্লাহকে তাঁর মর্যাদা অনুযায়ী যথার্থভাবে ভয় করা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?”
এ কথা শুনে আল্লাহ তা’আলা সূরা তাগাবুনের ১৬ নম্বর আয়াত “সুতরাং তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় করো” নাজিল করেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা জানিয়ে দেন, মানুষকে তাঁর ভয় যথাসাধ্য বা সাধ্যানুযায়ীই করতে হবে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কিছু তাফসীরকারকের মতে, সূরা আলে ইমরানের ১০২ নম্বর আয়াতের প্রথমাংশ সূরা তাগাবুনের ১৬ নম্বর আয়াত দ্বারা রহিত (নাসখ) হয়ে গেছে।
তবে অধিকাংশ তাফসীরকারক বলেন, এখানে কোনো আয়াত রহিত হয়নি। বরং সূরা তাগাবুনের আয়াতটি সূরা আলে ইমরানের আয়াতের ব্যাখ্যা বা পরিপূরক হিসেবে এসেছে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর: ৮/৩১১) ।
আয়াতাবলীর আমল:
(ক) ইহুদীদের ষড়যন্ত্র ও ইসলামবিরোধী মনগড়া বক্তব্য থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
(খ) আল্লাহকে সর্বোচ্চ ভয় করে আমৃত্যু ইসলামের পথে অটল থাকা।
(গ) ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থেকে ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থাকা।
(ঘ) ইহুদীদের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে দলাদলি বা বিভাজনে না জড়ানো।
(ঙ) আল্লাহর দেয়া নির্দেশনা ও আয়াতসমূহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সঠিক পথে চলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
(চ) কোরআন-সুন্নাহ কে শক্তভাবে ধারণ করা।