﴿كُلُّ الطَّعَامِ كَانَ حِلًّا لِبَنِي إِسْرَائِيلَ إِلَّا مَا حَرَّمَ إِسْرَائِيلُ عَلَى نَفْسِهِ مِنْ قَبْلِ أَنْ تُنَزَّلَ التَّوْرَاةُ قُلْ فَأْتُوا بِالتَّوْرَاةِ فَاتْلُوهَا إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (93) فَمَنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ (94) قُلْ صَدَقَ اللَّهُ فَاتَّبِعُوا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ (95)﴾ [سورة آل عمران: 93-95].
আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: ইহুদী কর্তৃক কতিপয় খাবার হারাম করা ও তার জবাব
আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৯৩। বনী ইসরাঈলের জন্য সকল খাবার হালাল ছিল, তবে তা ছাড়া যা তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে ইসরাঈল নিজের উপর হারাম করেছিল। বলো: তাহলে তোমরা তাওরাত নিয়ে এসো, অতঃপর তা তেলাওয়াত করো, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।
৯৪। অতএব এরপরও যারা আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা রটনা করে, তারা অবশ্যই যালিম।
৯৫। হে আল্লাহর রাসূল! বলো: আল্লাহ যথার্থই বলেছেন। অতএব একনিষ্ঠভাবে ইব্রাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ করো। আর সে মোশরিকদের অন্তর্ভুক্তছিল না।
আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
ইহুদীরা রাসূলুল্লাহকে (সা.) বলতো: সে উটের গোস্ত ও দুধ ভক্ষণ করা সত্তে¡ও কিভাবে ইব্রাহীমের (আ.) অনুসারী দাবী করে! অথচ তার ধর্মে উটের গোস্ত ও দুধ খাওয়া হারাম ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ভ্রান্ত দাবী খন্ডন করে বলেন: তাদের দাবী ভুল, কারণ বনী ইসরাঈলের উপর সকল প্রকার খাবার হালাল ছিল, ইব্রাহীমের (আ.) ধর্মে এ জাতীয় কোন কিছুই হারাম ছিল না। তবে ইয়াকুব (আ.) একটি গুরুতর রোগ থেকে আরোগ্যের জন্য আল্লাহর কাছে মানত করেছিলেন, যদি তিনি রোগ থেকে আরোগ্য পান, তাহলে তার প্রিয় খাবার উটের গোস্ত ও দুধ আর কখনও আহার করবেন না। এ হিসেবে তার উপর উটের গোস্ত ও দুধ অবৈধ হয়েছিল, আর বাকী সকলের উপর তা ভক্ষণ করা জায়েজ ছিল এবং এখনও জায়েজ আছে। এটা হলো তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের ঘটনা। সুতরাং এটাকে তারা কিভাবে অভিযোগ হিসেবে উত্থাপন করতে পারে!? অতঃপর যখন তাওরাত অবতীর্ণ করা হলো, তখন তাদের অত্যাচার, আবাধ্যতা ও গোড়ামীর কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর কতিপয় খাবার হারাম করেছেন। এটা ছিল মূল কাহিনী। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জানিয়ে দিলেন, যদি তারা এ ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করতে চায়, তাহলে তারা তাওরাত নিয়ে আসুক, সেখানে এ বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। এরপরেও যদি তারা তাদের দাবীর উপর একাট্টা হয়ে থাকে, তাহলে তাওরাত থেকে তাদের দাবীর স্বপক্ষে প্রমাণ নিয়ে আসুক। আসলে তাওরাতে তাদের দাবীর স্বপক্ষে কোন দলীলই নেই।
আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের অসার কথাবার্তার যৌক্তিক খন্ডনের পর এবং তাওরাত থেকে তাদের দাবীর স্বপক্ষে কোন দলীল না পাওয়ার পরেও যদি তারা আল্লাহর উপর মিথ্যাচার চালিয়ে যায়, তাহলে তারা নিশ্চিত অত্যাচারী, তাদের সাথে কোন আপোষ নেই।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মাধ্যমে তাদেরকে আবারও সতর্ক করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তারা জেনে রাখুক আল্লাহ তায়ালা যা বলেছেন, তা সত্য। সুতরাং তাদের উচিত মোহাম্মদের (সা.) শরীয়াতকে একনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করা, যা ইব্রাহীম (আ.) এর ধর্ম ছিল। আর ইব্রাহীম (আ.) কখনও এক মুহুর্তের জন্যও মুশরিক ছিলেন না। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৪/৬-৭, আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৪৮-৩৪৯, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৬২, আল-মোন্তাখাব: ১/১০১) ।
আয়াতাবলীর বিরল শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿الطَّعَامِ﴾ ‘খাবার’, আরবী ভাষায় শব্দটি সাধারণত রুটি এবং ভুট্টা দিয়ে তৈরি খাবারকে বুঝানো হয়। তবে অত্র আয়াতে যা খেয়ে মানুষ জীবণ ধারণ করে, এমন সকল খাবারকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৪/৪, তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৯৩) ।
﴿إِسْرَائِيلُ﴾ ‘ইসরাঈল’, এটা ইবরানী ভাষার একটি শব্দ। যার অর্থ হলো- আল্লাহর বান্দা। শব্দটি ইয়াকুব ইবনু ইসহাক এর উপাদি। এজন্য তার বংশধরকে ‘বানু ইসরাঈল’ বলা হয়। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৪/৫) ।
﴿مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ﴾ ‘এরপরে’, আয়াতাংশে ‘এর’ দ্বারা ৯৩নং আয়াতে আল্লাহ কর্তৃক ইহুদীদের অসার দাবীর যৌক্তিক খন্ডনের দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৪/৫) ।
﴿مَا حَرَّمَ إِسْرَائِيلُ عَلَى نَفْسِهِ﴾ ‘যা ইসরাঈল নিজের জন্য হারাম করেছিল’, এখন প্রশ্ন হতে পারে, ইসরাঈল (আ.) নিজের উপর কি হারাম করেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ইমাম রাযী (রা.) তার তাফসীরে কয়েকটি মত উল্লেখ করেছেন:
(ক) আবু আলিয়া, আতা এবং মুকাতিল (র.) বলেন: ইয়াকুব (আ.) গুরতর রোগের করণে নিজের জন্য তার প্রিয় দুই খাবার উটের গোস্ত এবং দুধকে হারাম করে নিয়েছিলেন।
(খ) একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, (ক) কলিজা এবং (খ) পিটের চর্বি ছাড়া অন্য যে কোন ছর্বি।
(গ) আরেকটি মত পাওয়া যায়, রগ বা শিরা। ইমাম রাযী (র.) প্রথম মতটিকে প্রধান্য দিয়েছেন। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২৯২) ।
উল্লেখিত আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতের সম্পর্ক:
অত্র সূরার শুরু থেকে ৯২নং পর্যন্ত আয়াতাবলীতে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ ও রাসূলুল্লাহর (সা.) রিসালাতের প্রমাণ পেশ করার পাশাপাশি ইহুদী-খৃষ্টানদের বিভিন্ন বানানো মতবাদ ও ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাসকে বাতিল সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর উল্লেখিত আয়াতাবলী সহ পরবর্তী দুই আয়াত পর্যন্ত আয়াতাবলীতে ইহুদীদের দুইটি বানোয়াট এবং অযৌক্তিক দাবীর খন্ডন করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৪/৪) ।
৯৩নং আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
ইমাম ক্বালবী (র.) বলেন: অত্র আয়াত তখন অবতীর্ণ হয়, যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) ইহুদীদেরকে বলেছিলেন, আমরা ইব্রাহীমের (আ.) দীনের উপর আছি। তারা উত্তরে বললো: তোমরা কিভাবে ইব্রাহীমের দীনের উপর আছো? অথচ তোমরা উটের গোস্ত এবং দুধ আহার করে থাকো। রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিলেন: এগুলো ইব্রাহীমের (আ.) উপর হালাল ছিলো, আমরাও হালাল বলে জানি। এবারে ইহুদীরা বললো: নুহ ও ইব্রাহীম (আ.) থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যা কিছু হারাম ছিল আমরাও সে গুলোকে হারাম বলে বিশ্বাস করি। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখিত আয়াত অবতীর্ণ করে তাদেরকে নিজস্ব দাবীর ব্যাপারে মিথ্যাবাদী আখ্যা দেওয়া হয়েছে। (আসবাব আল-নুযুল, আল- ওয়াহেদী: ১/১১৮) ।
৯৩নং আয়াত সংশ্লিষ্ট ঘটনা:
ইয়াকুব (আ.) ‘ইরকুন্নিসা’ (সাইটিকা বাত) রোগে আক্রান্ত হয়ে মানত করেছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা এ রোগ থেকে মুক্তি দিলে তিনি সর্বাপেক্ষা প্রিয় খাবার পরিত্যাগ করবেন। এরপর তিনি রোগমুক্ত হয়ে যান এবং তার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় খাবার উটের গোস্ত এবং দুধ পরিত্যাগ করেন। (তাফসীর আলুসী: ২/২১৯) ।
আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। ৯৩নং আয়াত থেকে কয়েকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) রাসূলুল্লাহ (সা.) এর রিসালাতের সত্যতার প্রমাণ রয়েছে, যা আয়াতে বর্ণিত তিনটি বিষয় থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে:
(র) ‘বনী ইসরাঈলের উপর সকল খাবার হালাল ছিল’ এটা এক ধরণের গায়বি সংবাদ, কারণ বনী ইসরাঈলের আগমণ হয় রাসূলুল্লাহর (সা.) জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে। তখন কি খাবার বনী ইসরাঈলের জন্য হালাল ছিল, তা কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে না জানালে, তার জানার কথা ছিল না। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় আল্লাহ তায়ালা তাকে এ বিষয়ে সংবাদ দিয়েছেন।
(রর) ‘ইয়াকুব (আ.) রোগ থেকে মুক্তির জন্য নিজের উপর তার প্রিয় খাবার হারাম করেছিলেন’ এটাও এক ধরণের গায়েবী সংবাদ হওয়ার কারণে কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে না জানালে তার জানার কথা ছিল না। সুতরাং বুঝা যায় আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে তাকে সংবাদ দিয়েছেন।
(ররর) “তাওরাত নিয়ে এসো, তাতে এ বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে”, রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন নিরক্ষর, তিনি হিবরানী ভাষার তাওরাত পড়তে পারতেন না। আল্লাহ তায়ালা তাকে এ বিষয়ের জ্ঞান না দিলে তিনি জানতে পারতেন না। এটাও তার রিসালাতের প্রমাণ বহণ করে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, আল-রাযী: ৮/২৯০) ।
(খ) ইব্রাহীম, ইসহাক্ব, ইয়াকুব এবং ইউসূফের (আ.) আগমণ ঘটেছিল মূসার (আ.) আগমণের পূর্বে; কারণ আয়াতে বলা হয়েছে: “তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে ইয়াকুব (আ.) রোগ মুক্তির জন্য তার প্রিয় খাদ্যবস্তুকে হারাম করেছিলেন”।
(গ) মাসয়ালার সত্যতা প্রমাণের জন্য কোন আলেমের কাছে কোরআন-সুন্নাহ থেকে দলীল চাওয়া যাবে, এটা কোন ধরণের বেআদবী বা শিষ্টাচার বহির্ভুত কাজ বলে গণ্য হবে না, যেমনটা বর্তমান সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ মনে করে থাকে। উল্লেখিত আয়াতে বর্ণিত ঘটনার সত্যতা যাছাই এবং ইহুদীদের দাবীর পক্ষে দলীল পেশ করার জন্য তাওরাত নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। এছাড়াও সহীহ বুখারীর একটি দীর্ঘ হাদীসে দেখতে পাই, গ্রাম থেকে একজন লোক এসে রাসূলুল্লাহর রিসালাতের সত্যতা প্রমাণের জন্য তাকে অনেকগুলো প্রশ্ন করেছিলেন, আর রাসূলুল্লাহ (সা.) কোন ধরণের রাগ না করে হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন, অবশেষে ঐ ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিল (সহীহ আল-বুখারী: ৬৩) ।
২। ইসলামের মৌলিক বিধান সকল নবী-রাসূলের যুগে এক ছিল এবং কিয়ামত পর্যন্ত একই থাকবে, তাতে কোন ধরণের পরিবর্তণ আসবে না। যেমন: ইসলামের অন্যতম একটি মৌলিক বিধান হলো- ‘আসলুস সাইয়্য ইবাহা’ অর্থাৎ: কোন জিনিসের আসল হলো জায়েজ হওয়া। এ নিয়মের আলোকে মুবাহ সকল খাবারই সকল যুগে সকল মানুষের উপর হালাল ছিল, আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। তবে দুইটি যায়গায় এর ব্যতিক্রম হয়েছে:
(ক) ‘ইয়াকুব’ (আ.) গুরুতর রোগ থেকে আরোগ্যের জন্য নিজের উপর তার প্রিয় দুইটি খাবার হারাম করে নিয়েছিল। যা অত্র আয়াত থেকে প্রতিয়মান হয়। এ ঘটনা ঘটেছিল তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে।
(খ) তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার পরের ঘটনা হলো- বনী ইসরাঈলদের অতিরিক্ত হটকারিতা, বাড়াবাড়ি, যুলম এবং একগুয়েমির কারণে আল্লাহ তায়ালা কতিপয় মুবাহ খাদ্যবস্তুকে শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাদের উপর হারাম করেছিলেন। যেমন: এ সম্পর্কে কোরআনে এসেছে:
﴿فَبِظُلْمٍ مِنَ الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَاتٍ أُحِلَّتْ لَهُمْ وَبِصَدِّهِمْ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ كَثِيرً﴾ [سورة النساء: ১৬০].
অর্থাৎ: “ইহুদীদের যুলম এবং আল্লাহ পথে বেশী বেশী বাধা দেওয়ার কারণে তাদের উপর হালালকৃত পবিত্র বস্তুকে আমি হারাম করে দিয়েছিলাম” (সূরাতু আন-নিসা: ১৬০) ।
অন্য আরেকটি আয়াতে এসেছে:
﴿وَعَلَى الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا كُلَّ ذِي ظُفُرٍ وَمِنَ الْبَقَرِ وَالْغَنَمِ حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ شُحُومَهُمَا إِلَّا مَا حَمَلَتْ ظُهُورُهُمَا أَوِ الْحَوَايَا أَوْ مَا اخْتَلَطَ بِعَظْمٍ ذَلِكَ جَزَيْنَاهُمْ بِبَغْيِهِمْ وَإِنَّا لَصَادِقُونَ﴾ [سورة الأنعام: ১৪৬).
অর্থাৎ: “আর আমি ইহুদীদের জন্য নখযুক্ত সকল পশুই হারাম করে দিয়েছিলাম; গরু এবং ছাগলের চর্বিও আমি তাদের জন্য হারাম করেছিলাম; তবে জন্তুর চর্বির যা কিছু তাদের উভয়ের পিঠ, আত কিংবা হাড়ের সাথে জড়ানো থাকে তা হারাম নয়। এভাবেই এগুলোকে হারাম করে আমি তাদের অবাধ্যতার জন্যে তাদের শাস্তি দিয়েছিলাম, নিসন্দেহে আমি সত্যবাদী” (সূরাতু আল-আনয়াম: ১৪৬) ।
উল্লেখিত দুই ঘটনার বাহিরে আল্লাহ তায়ালা এ বিধানের ক্ষেত্রে কোন ব্যতিক্রম হয়েছে বলে কোন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। ইহুদীরা যে দাবী করে ইব্রাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব সহ সকল নবী-রাসূলের উপর উটের গোস্ত ও দুধ হারাম ছিল এ দাবী মিথ্যা ও বানোয়াট।
তবে মানতের মাধ্যমে কোন হারাম বস্তুকে হালাল করা অথবা কোন হালাল বস্তুকে হারাম করার রীতি চিরতরে রহিত হয়ে গিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) মারিয়া কিবতীকে খুশী করার জন্য নিজের উপর মধু পান হারাম করেছিলেন। পরে আল্লাহ তায়ালা তাকে হালালকে এভাবে হারাম করা থেকে কঠিনভাবে নিষেধ করেছিলেন। এর বর্ণনা সূরাতু আত-তাহরীমে এসেছে।
৩। ৯৪নং আয়াত থেকে বুঝা যায় কোন বিষয়ে আল্লাহর স্পষ্ট বর্ণনার বিরোধিতা করা তার সাথে মিথ্যাচার করার শামিল। আর যারা এভাবে মিথ্যাচার করে, তারা যালিম বা অত্যাচারী। আর আল্লাহ তায়ালা অত্যাচারীদেরকে মোটেই পছন্দ করেন না (সূরাতু আলে-ইমরান: ৫৭,১৪০ এবং সূরাতু আল-শুরা: ৪০) । ইহুদীরা এ অপরাধটি বরাবরই করে যাচ্ছে। আল্লাহর সাথে তাদের মিথ্যাচারের কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হলো:
(ক) আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য সকল খাদ্যবস্তুকে হালাল করেছেন, আর তারা বলে কতিপয় খাবার বাদ দিয়ে বাকী খাদ্যবস্তু তাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। ৯৩নং আয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
(খ) আল্লাহ তায়ালা বলেন: তাঁর হাত অতি প্রশস্ত, আর ইহুদীরা বলে: আল্লাহর হাত সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছে। যেমন সূরাতু আল-মায়িদা এর ৬৪নং আয়াতে এসেছে:
﴿وَقَالَتِ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنْفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ﴾ [سورة المائدة: ৬৪].
অর্থাৎ: “ইহুদীরা বলে: আল্লাহর হাত সংকীর্ণ, আসলে তাদের হাতই সংকীর্ণ। তাদের এই বেপরোয়া কথাবার্তার জন্য তারা অভিশপ্ত হয়েছে। বরং আল্লাহর দুই হাতই প্রশস্ত, তিনি যেভাবে ইচ্ছা দান করেন” (সূরাতু আল-মায়িদাহ: ৬৪) ।
(গ) আল্লাহ তায়ালা বলেন: তিনি অমুখাপেক্ষী, আর তারা বলে: তিনি মুখাপেক্ষী। যেমন সূরা আলে-ইমরানের ৮১নং আয়াতে এসেছে:
﴿لَقَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ سَنَكْتُبُ مَا قَالُوا وَقَتْلَهُمُ الْأَنْبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَنَقُولُ ذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ﴾ [سورة آل عمران: ৮১].
অর্থাৎ: “যারা বলে: আল্লাহ ফকীর আর আমরা ধনী, আল্লাহ তাদের কথা শুনছেন। আমি তাদের কথাগুলো এবং অন্যায়ভাবে নবী হত্যার বিষয়ে লিখে রেখেছি এবং অচিরেই তাদেরকে বলবো: তোমরা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করো” (সূরাতু আলে-ইমরান: ৮১) ।
(ঘ) আল্লাহ তায়ালা বলেন: অন্যকে ক্ষতি করা গুনাহের কাজ, আর ইহুদীরা বলে: মুসলিমদের ক্ষতি করাতে কোন গুনাহ নেই। যেমন সূরাতু আলে-ইমরানের একটি আয়াতে এসেছে:
﴿..وَمِنْهُمْ مَنْ إِنْ تَأْمَنْهُ بِدِينَارٍ لَا يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ إِلَّا مَا دُمْتَ عَلَيْهِ قَائِمًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الْأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ﴾ [سورة آل عمران: ৭৫].
অর্থাৎ: “..এবং আহলে কিতাবের কিছু লোক আছে, যাদের কাছে তুমি একটি টাকাও আমানত রাখলে, তোমার শক্তি প্রয়োগ ছাড়া তা তোমাকে ফেরত দিবে না; কারণ তারা বিশ্বাস করে মুসলমানদের ক্ষেত্রে তাদের কোন গুনাহ হবে না। আর তারা জেনেবুঝে আল্লাহর ব্যাপারে এভাবে মিথ্যাচার করে থাকে” (সূরাতু আলে-ইমরান: ৭৫) ।
(ঙ) তারা আল্লাহকে বলে, তাঁর সন্তান আছে, অথচ তিনি সন্তান থেকে সম্পূর্ণ পুতপবিত্র। এ বিষয়ে সূরাতু ইউনুস এর দুইটি আয়াতে এসেছে:
﴿قَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ هُوَ الْغَنِيُّ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ إِنْ عِنْدَكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ بِهَذَا أَتَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ (৬৮) قُلْ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ﴾ [سورة يونس: ৬৮-৬৯].
অর্থাৎ: “তারা বলে: আল্লাহ তায়ালা সন্তান গ্রহণ করেছেন। অথচ তিনি পুতপবিত্র, তিনি আকাশ-যমীনের সবকিছু থেকে অমুখাপেক্ষী। তাদের কাছে এ দাবীর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই, তারা আল্লাহ সম্পর্কে না জেনে কথা বলে থাকে। হে আল্লাহর নবী! আপনি তাদের বলে দিন: যারা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে মিথ্যাচার করে, তারা কখনও সফল হবে না” (সূরাতু ইউনুস: ৬৮-৬৯) ।
(চ) ইহুদীরা আল্লাহর বিধানকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের মন মতো যাকে ইচ্ছা হালাল করে এবং যাকে ইচ্ছা হারাম করে থাকে। এ বিষয়ে সূরাতু আল-নাহল এর একটি আয়াতে এসেছে:
﴿وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ﴾ [سورة النحل: ১১৬].
অর্থাৎ: “তোমাদের জিহŸা আল্লাহ তায়ালার উপর মিথ্যা আরোপ করে বলেই কখনও এ কথা বলো না, এটা হালাল এবং ওটা হারাম, জেনে রেখো, যারাই আল্লাহর উপর মিথ্যাচার করে, তারা কখনও সাফল্য লাভ করতে পারবে না” (সূরাতু আল-নাহল: ১১৬) ।
(ছ) আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত রিসালাতকে তারা জাদুমন্ত্র বলে আখ্যা দিয়েছে, যেমন সূরা আল-সাফ এর (৬-৭) নং আয়াতে এসেছে:
﴿.. فَلَمَّا جَاءَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُبِينٌ (৬) وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُوَ يُدْعَى إِلَى الْإِسْلَامِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾ [سورة الصف: ৬-৭].
অর্থাৎ: ‘..যখনই তাদের কাছে কোন রাসূল স্পষ্ট বাণী নিয়ে এসেছে, তখনই তারা বলেছে এটাতো স্পষ্ট জাদু। আল্লাহর উপর যে মিথ্যাচার করে তার চেয়ে বড় যালিম কেউ নেই, অথচ তাকে ইসলামের দিকে ডাকা হচ্ছে, আল্লাহ কখনও যালিম সম্প্রদায়কে সঠিক পথ দেখান না” (সূরাতু আল-সাফ: ৬-৭) ।
(জ) ইহুদীরা নিজেদের হাতে কিতাব লিখে বলতো এটা আল্লাহ তায়ালার কিতাব, যেমন সূরাতু আল-বাক্বারা এর একটি আয়াতে এসেছে:
﴿فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَذَا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا فَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا يَكْسِبُونَ﴾ [سورة البقرة: ৭৯].
অর্থাৎ: “ধংস তাদের জন্য যারা নিজেদের হাতে কিতাব লিখে সামান্য মূল্যে বিক্রয় করার জন্য বলে এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। সুতরাং তারা যা লিখেছে এবং যা অর্জন করেছে তার জন্যই তারা ধংস হবে” (সূরাতু আল-বাক্বারা: ৭৯) ।
(ঝ) ইহুদীরা তাদের নিজেদের হাতে লিখিত কিতাব জিহ্বা নেড়ে এমনভাবে পাঠ করে যাতে শ্রোতা এটাকে আল্লাহর কিতাব মনে করে, যেমন সূরাতু আলে-ইমরানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
﴿وَإِنَّ مِنْهُمْ لَفَرِيقًا يَلْوُونَ أَلْسِنَتَهُمْ بِالْكِتَابِ لِتَحْسَبُوهُ مِنَ الْكِتَابِ وَمَا هُوَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَقُولُونَ هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَمَا هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ﴾ [سورة آل عمران: ৭৮].
অর্থাৎ: “তাদের একটি দল তাদের কিতাবকে জিহ্বা নেড়ে এমনভাবে তেলাওয়াত করে যাতে তোমরা তাকে আল্লাহর কিতাব মনে কর এবং তারা বলে এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, আসলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি। আর তারা জেনেবুঝে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যাচার মূলক কথা বলছে” (সূরাতু আলে-ইমরান: ৭৮) ।
এভাবে ইহুদীরা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যাচার করে অত্যাচারী হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা অত্যাচারীকে মোটেই পছন্দ করেন না। সুতরাং তারা আল্লাহর কাছে ঘৃণিত।
৪। ৯৫নং আয়াতে তিনটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে:
(ক) আল্লাহ তায়ালা সর্বদা সত্য বলেন। এ সম্পর্কে কোরআনে আরো দুইটি আয়াত এসেছে সূরাতু আন-নিসা এর ৮৭ এবং ১২২নং আয়াত।
(খ) ইব্রাহীমের (আ.) ধর্মকে অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে কোরআনে আরো পাঁচটি আয়াত এসেছে: সূরাতু আল-বাক্বারা: ১৩০ ও ১৩৫, সূরাতু আল-নিসা: ১২৫, সূরাতু আল-আনয়াম: ১৬১ এবং সূরাতু আল-নাহল: ১২৩।
(গ) ইব্রাহীম (আ.) মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। এ সম্পর্কে কোরআনে আরো পাঁচটি আয়াত এসেছে: সূরাতু আল-বাক্বারা: ১৩৫, সূরাতু আলে ইমরান: ৬৭ ও ৯৫, সূরাতু আল-আনয়াম: ১৬১ এবং সূরাতু আল-নাহল: ১২৩।
আয়াতাবলীর আমল:
১। হালাল বস্তুকে হারাম এবং হারাম বস্তুকে হালাল করার চেষ্টা না করা।
২। কোন মাসয়ালার স্বপক্ষে কোরআন-সুন্নাহ থেকে দলীল পেশ করা।
৩। ইসলামকে অনুসরণের মাধ্যমে ইব্রাহীমের (আ.) ধর্মকে অনুসরণ করা।